সংসদে বিরোধী দলের অপমৃত্যু

একটি বিরোধী দল বিহীন সংসদের যে বিপদগুলো রয়েছে, সে বিষয়ে কি নতুন সরকার সচেতন হবে?
সংসদে বিরোধী দলের অপমৃত্যু
ফাইল ফটো | পিআইডি

তত্ত্বাবধায়ক সরকার, মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের তিনজন সংসদ সদস্যকে ঠাঁই দেওয়ার মতো বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিশ্বকে উপহার দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ধন্যবাদ পেতেই পারে। এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন হলো বিরোধী দল বিহীন সংসদ।

মঙ্গলবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা খুব সম্ভবত ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থায় বিশ্বের একমাত্র প্রকৃত বিরোধী দল বিহীন সংসদ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। ১১ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর প্রতিটি আসন জাতীয় পার্টি পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের বদান্যতায়।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সংসদে বিরোধী দল কখনোই খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। প্রত্যাশিতভাবেই দেশের প্রথম সংসদ বঙ্গবন্ধুর পর্বতসম ব্যক্তিত্বের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে ছিল এবং বিরোধিতার কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। পরবর্তীতে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলগুলোকে নির্মূল করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। সেই সময় আমাদের সংবিধান পরিবর্তন করে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়।

এরপর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং আমাদের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সামরিক বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আগ পর্যন্ত সংসদে 'বিরোধী দলের' ইতিহাসকে মোটামুটি 'গৃহপালিত বিরোধী দলের' ইতিহাস বলা যায়।

১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবকিছু নতুন করে শুরু করার সুযোগ আসে। গণতন্ত্র ও সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। এই নির্বাচনে আমরা সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে পাই—যেখানে বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন পায়। খালেদা জিয়া জামায়াতের ১৮ এমপিসহ ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৮ আসন নিয়ে জোট সরকার গঠন করেন। ওই রাজনৈতিক জোটটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক ছিল, যার অনেক বড় মূল্য খালেদা জিয়াকে পরবর্তীতে চুকাতে হয়েছে।

ওই নির্বাচনটি ছিল সংসদীয় রাজনীতির উন্নয়ন এবং একইসঙ্গে সুশাসন প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের অত্যাবশ্যক ভূমিকাকে কার্যকর করার এক অভূতপূর্ব সুযোগ। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার স্বপক্ষে অগ্রগামী ভূমিকা পালনকারী দল আওয়ামী লীগের ৮৮ জন সংসদ সদস্য চাইলে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের সংস্কৃতি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন। সরকারের কার্যক্রমের ওপর নজর রেখে আওয়ামী লীগ হাতেকলমে দেখিয়ে দিতে পারত, বিরোধী দলের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তাদের সেই অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই পরিমাণ পরিপক্বতা ছিল না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আওয়ামী লীগ নিয়মিত 'ওয়াকআউট' ও স্বল্প মেয়াদে সংসদ বর্জনের পথ বেছে নেয়। পরবর্তীতে বর্জনের সময়সীমা বাড়তে থাকে এবং সরকারের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে তারা সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন। 'বিরোধী দল' হিসেবে পুরো পাঁচটি বছর আওয়ামী লীগ পার করে দেয় বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের প্রচেষ্টায় এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের দাবিতে। সংসদীয় ব্যবস্থার কার্যকারিতায় মৌলিক অনুষঙ্গ হলো ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সমন্বয়মূলক ভূমিকা, যা ওই সংসদে একেবারেই হয়নি।

১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং সেবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত যথাক্রমে ১৪৬, ১১৬, ৩২ ও তিনটি আসনে জয়লাভ করে। সেই সংসদেও অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু সেবারও একটি পরিপক্ব সংসদীয় ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সরকারের কার্যক্রমের বিপরীতে বিরোধী দলের 'ওয়াচডগ'র ভূমিকা পালনের সুযোগ হারায়। কারণ, বিএনপিও আওয়ামী লীগের দেখানো পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাদের মেয়াদের পুরো সময় ব্যয় করে সরকারের সব কাজে বাধা সৃষ্টির জন্য। এর মাধ্যমে 'বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা'র চর্চা আরও বলিষ্ঠ রূপ পায়।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদে ক্ষমতায় ফেরে বিএনপি এবং ৬২ আসন নিয়ে বিরোধী দলের মর্যাদা পায় আওয়ামী লীগ। আগের তুলনায় আসন সংখ্যা কম হলেও বলিষ্ঠ ও সমীহ জাগানিয়া বিরোধী দল হওয়ার জন্য এই সংখ্যা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারা কেবল অতীতের তিক্ততা ও ধ্বংসাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পুনরাবৃত্তিতে আগ্রহী ছিল। আমরা আবারও অন্তহীন ওয়াকআউট, বর্জন ও পদত্যাগ দেখতে পাই এবং সেবারও সংসদীয় ব্যবস্থাকে বলিষ্ঠ করার কোনো উদ্যোগ ছিল না।

নবম সংসদ গঠিত হয় সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আওয়ামী লীগ ২৩০ আসনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে আর বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পায়। আওয়ামী লীগ এই অবিসংবাদিত সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের অজুহাতে তড়িঘড়ি করে ভবিষ্যতের সব নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। যদিও তারা হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত রায়ের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যায়, হাইকোর্ট আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছিল।

এই প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানায়। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে আমাদের সংসদীয় ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পর্যায়টি শুরু হয়। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ফলে প্রথমবারের মতো আমাদের সংসদে কোনো প্রকৃত বিরোধী দলের উপস্থিতি ছিল না। যার ফলে ক্ষমতাসীন দল তাদের যা ইচ্ছে তাই করার সুযোগ পেয়ে যায়।

আগের নির্বাচনগুলোতে আমরা দেখেছি, ক্রমান্বয়ে সংসদের গুরুত্ব হারানোর ইতিহাস। কিন্তু দ্বাদশ সংসদে এসে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে বিরোধী দলের অপমৃত্যু হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটি সংসদের মৌলিক ভূমিকার অংশ, যা এবার পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকবে। দুর্বল হলেও এতদিন জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া চালু ছিল, তা এবার পুরোপুরি উধাও হয়ে যাবে।

সংসদের কর্তৃত্ব পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের হাতে চলে যাওয়ায় সরকারের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পরস্পরের ওপর নজর রাখার সমন্বিত প্রক্রিয়া ধসে পড়েছে। আমাদের সংবিধানের বুনিয়াদি ভূমিকাগুলোর অন্যতম হলো এই সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়াকে প্রতিরোধ করা। আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এখন এসে দেখতে পেলেও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগেই। বলা বাহুল্য, এতে সুশাসন প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়বে।

যখন নির্বাহী বিভাগ সংসদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়ে যায়, তখন বিচার বিভাগেও এর প্রভাব পড়ে। এটি সরকার সংশ্লিষ্ট বিষয় হওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর বড় আকারে চাপ প্রয়োগ করা হয়। এখন এর মাত্রা আরও বাড়বে।

জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে আমলারা হয়তো আরও বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠবেন। এর কারণ হলো, দিন শেষে সংসদ সদস্য ও আমলা উভয়ই সরকারপ্রধানের ওপর বড় আকারে নির্ভরশীল। সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফলের কারণে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সংসদ সদস্যরা আরও বেশি আমলানির্ভর হয়ে উঠবেন।

বিরোধী দল বিহীন সংসদের কাছে কোনো প্রত্যাশাই থাকে না, বিশেষত জবাবদিহির বিষয়ে। অথচ, সংসদ পরিচালনায় জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় জানা গেছে, সংসদে শুধু অধিবেশন চালাতেই প্রতি মিনিটে দুই লাখ ৭২ হাজার টাকা খরচ হতো।

এ ধরনের একপাক্ষিক সংসদ সরকারের জন্যও বিপজ্জনক। কারণ, এর ফলে তারা প্রকৃত বিরোধী দলের করা গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা কখনোই শুনতে পাবে না।

গত বুধবার আব্দুল গফুর স্মৃতি বক্তৃতায় অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, যদি প্রকৃতপক্ষে নাগরিকদের অবাধ ভোটের ওপর নির্ভরশীল এবং নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ শাসন ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে এই প্রতিটি ক্ষেত্রে (পরিবেশ, শিক্ষা ও সুশাসন) ত্রুটির সুযোগ সবসময়ই থাকে।

একটি বিরোধী দল বিহীন সংসদের যে বিপদগুলো রয়েছে, সে বিষয়ে কি নতুন সরকার সচেতন হবে?

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

$800m repayment to Russia in limbo

About $809 million has piled up in a Bangladesh Bank escrow account to repay loans and interest for the Russia-funded Rooppur Nuclear Power Plant.

9h ago