শিক্ষকদের বিবাদের বলি কেন শিক্ষার্থীরা হবেন?

বাংলাদেশে নানা বিষয়ে রেকর্ড গড়ার প্রবণতা আছে। এ বিষয়ে খুব সম্ভবত নতুন একটি মাইলফলক স্থাপন করলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

উপাচার্য ও শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শেষ চিত্রনাট্যে ২৮ এপ্রিল হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। উপাচার্য ও শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং হল খালি করার নির্দেশ দেওয়ার রেকর্ড বাংলাদেশে নিকট অতীতে হয়েছে কি না, তা একটু খুঁজে দেখা দরকার।

যদিও আশার কথা হচ্ছে, স্বার্থসিদ্ধির সংঘাতে হল ছাড়ার আদেশ অমান্য করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে।

বছরের প্রথম প্রান্তিকের সেমিস্টারটা বেশ ছোট্ট। রমজান, দুটি ঈদ, পূজাসহ নানা ছুটি থাকায় এই সেমিস্টারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মোটামুটি দৌঁড়ের ওপর থাকতে হয়। তাদের ওপর বাড়তি চাপ থাকে। সময় মতো কোর্স শেষ করতে শিক্ষকদেরও বেশ হিমশিম খেতে হয়।

এমন অবস্থায় মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট ও চূড়ান্ত পরীক্ষার অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অথচ, এর পেছনে শিক্ষার্থীদের বিন্দুমাত্র দায় নেই। শুধুমাত্র প্রশাসনের অদক্ষতা ও স্বার্থ সংঘাতের কারণে তাদের এই শাস্তি।

এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী টিউশনিসহ নানা কাজে যুক্ত। অত্যন্ত অবিবেচকের মতো আবাসিক হল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের সামনের দিনগুলোকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অ্যাকাডেমিক ও আর্থিকভাবে শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি কারা করলেন? প্রতিষ্ঠানের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা—উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতি।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে উপাচার্যের দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই চলছে। শিক্ষক সমিতির দাবি, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন অদক্ষ। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ থেকে ১৮ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন।

যদিও উপাচার্য বিভিন্ন মাধ্যমে দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। কিন্তু তিনি কারো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে শিক্ষক সমিতির সঙ্গে বসলেও শিক্ষকরা তাকে স্লেজিং করেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখের ভাষা 'যাচ্ছেতাই' বলেও উল্লেখ করেছেন উপাচার্য।

নানা বিষয়ে চলা দীর্ঘদিনের এই দ্বন্দ্ব আর স্লেজিং গত ২৮ এপ্রিল মারাত্মক রূপ নেয়। এ দিন সাত দফা দাবিতে চলা শিক্ষকদের আন্দোলনের মধ্যে নিজ কার্যালয়ে ঢুকতে চাইলে উপাচার্যকে বাধা দেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। উপাচার্য, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্রলীগের নেতা—সবাই মিলে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেন।

এ সময় শিক্ষকদের 'কনুইবাজী' ভিডিওচিত্রে ধরা পড়ে। একবার ভাবুন, শিক্ষাঙ্গনে উপাচার্য, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রনেতারা ধাক্কাধাক্কি, ধস্তাধস্তি, কনুইবাজী করছেন—এমন দৃশ্যে কার সুনাম বাড়লো। এতে কী  অভিভাবকদের সামনে শিক্ষকদের মাথা নিচু হলো নাকি উঁচু হলো? কেউ কি ভাবছেন, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী?

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক কাঠামোতে একটা গুরুতর গলদ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কাদের জন্য? সেখানে মূল চরিত্র কারা? কাদের জন্য এই শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী? এই প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন।

সারাবিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চরিত্র শিক্ষার্থীরা—তাদের স্বার্থই প্রধান, তাদের চাওয়াই সর্বাগ্রে বিবেচ্য, তাদের কল্যাণই একান্ত কাম্য। কিন্তু হায়! বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ ক্লাস, বন্ধ পরীক্ষা। হল বন্ধেরও চেষ্টা চলছে।

এমন স্বার্থ-দ্বন্দ্বে শিক্ষার্থীদের বলি দিয়ে কতদূর যাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি? সমাজের কাছে কী বার্তা যাবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে? এতো অদক্ষ প্রশাসন আর স্বার্থ-সচেতন শিক্ষকদের নিয়ে কীভাবে শিক্ষার্থীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব?

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অযোগ্য উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতা নতুন কিছু নয়। কিছু ক্ষেত্রে তাদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, স্বজনপ্রীতি ও সীমাহীন দুর্নীতি উপকথায় পরিণত হয়েছে, যা দেশবাসীর কাছে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে চরমভাবে। একইসঙ্গে শিক্ষক সমিতিগুলোর অতিমাত্রায় রাজনীতি ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে সংঘাত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

দেখা যাচ্ছে, অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই অনেকে স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার চেষ্টা করছেন। আবার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতের অমিল বা স্বার্থে আঘাত লাগলেই শিক্ষক সমিতি বা শিক্ষকদের একাংশ যুক্ত হচ্ছেন উপাচার্য-উচ্ছেদ আন্দোলনে। এই নিয়েই দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র ও সংঘাত।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঠিক কী ঘটেছে, তা জানা কঠিন। ভেতরে ভেতরে হয়তো অনেক কুৎসিত স্বার্থের সমীকরণ আছে। তবে এটা স্পষ্ট যে মূল মারামারি উপাচার্যের ক্ষমতাচর্চা ও শিক্ষকদের স্বার্থ নিয়েই। যার নির্মম বলি বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছয় হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। বিপুল সংখ্যক এই শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাওয়ার অর্থ তাদের অনেক বড় ক্ষতি, অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি আর বাড়তে দেওয়া কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়।

অবিলম্বে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে। শুরু করতে হবে ক্লাস ও পরীক্ষা। তা না হলে সমাজে উপাচার্য ও শিক্ষকদের নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা আছে, তা আরও বাড়তে পারে। যে ক্ষতি সবার। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি শিক্ষার্থীদের।

রাহাত মিনহাজ, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

6h ago