তো চাকরিপ্রার্থীরা কোথায় পড়বেন?

'বন্ধ হচ্ছে ঢাবির লাইব্রেরিতে বিসিএস পড়াশোনা', 'ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য আর নয়', 'ঢাবির গ্রন্থাগারে বিসিএস ও চাকরিপ্রার্থীদের পড়াশোনা বন্ধ'—এমন শিরোনামের খবর বেশ কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে।

অনেক ক্ষেত্রে সংবাদের এঙ্গেল এমন বাঁকাত্যাড়া যে, মনে হয় বিসিএস বা চাকরির জন্য পড়াশোনা খুব অন্যায় কাজ, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে চাকরির পড়াশোনা রীতিমতো অপরাধ। কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই তাই? আমার তা মনে হয় না।

বিসিএস বা সরকারি-বেসরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা অন্যায় বা অনৈতিক কিছু না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে চাকরির প্রস্তুতি বিষয়ক পড়াশোনাও নেতিবাচক না। চাকরি পেতে বিভিন্ন ধরনের শর্টকার্ট পদ্ধতি পাশ কাটিয়ে একজন শিক্ষার্থী সাত-সকালে ব্যাগ ও পানির বোতল নিয়ে গ্রন্থাগারমুখী হচ্ছেন—এ দৃশ্য আমাকে আনন্দ দেয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা কেন শুধু চাকরির পেছনে ছুটছেন, এ নিয়ে উচ্চমার্গীয় বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে একটি সরকারি চাকরি তাদের কাছে সোনার হরিণ। শিক্ষার্থীদের পরিবারও কায়মনোবাক্যে একটা সরকারি চাকরি কামনা করেন। আর তাই এই চাকরির প্রস্তুতির পড়াশোনায় আমি খারাপ কিছু দেখি না।

মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের ও সদ্য শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়া শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন। যাদের মূল লক্ষ্য বিসিএস অথবা অন্য সরকারি-বেসরকারি চাকরি। যারা শেষবর্ষের শিক্ষার্থী, তারা আবাসিক হলেও পড়াশোনা করতে পারেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর রিডিং রুম মানসম্মত না হওয়ায় তারা লাইব্রেরিতে আসেন।

লাইব্রেরিতে আসার অন্যতম কারণ এয়ারকন্ডিশন। একবার ভাবুন, দেশে যখন উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনতে শুনতে আমাদের মোটামুটি হাবুডুবু খাওয়ার দশা, তখন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আবাসিক হলের রিডিং রুমে আজ পর্যন্ত এসি লাগানো যায়নি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি ২০১১ সালে। তখন দেখেছি, টয়লেটের পাশে স্থাপিত জিয়া হলের রিডিং রুমে শিক্ষার্থীরা কী নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়াশোনা করেন। এ ছাড়া, যেনতেন সুযোগ-সুবিধার রিডিং রুমটির প্রায় শতভাগ চেয়ার ছিল ছারপোকা সমৃদ্ধ।

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডিং রুমগুলোর পরিস্থিতি কী, তা জানতে মোবাইলে কল করেছিলাম একজন হাউস টিউটরকে। তিনি জানালেন, ২০২৪ সালেও হলের রিডিং রুমগুলোর অবস্থা মোটামুটি করুণ। ভালো চেয়ার-টেবিল নেই। এসি তো অনেক দূরের কথা। আর হ্যাঁ, ২০১১ সালের মতোই রিডিং রুমগুলো এখনো অপরিষ্কার এবং ছারপোকা সমৃদ্ধ।

তো, এমন বাস্তবতায় চাকরির পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের শিক্ষার্থীরা যদি লাইব্রেরিমুখী হন, তাতে অন্যায় কোথায়?

এবার আসা যাক শিক্ষাবর্ষ শেষ করা শিক্ষার্থীদের কথায়। হ্যাঁ, পড়াশোনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ব্যবহার করাটা হয়তো অনৈতিক। কিন্তু তারা যাবেন কোথায়? শাহবাগের সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার বন্ধ। চার বছর ধরে সংস্কারকাজ চলছে। হয়তো, নতুন করে যাত্রা শুরুর পর এই গ্রন্থাগারটি একটি ভালো জায়গা হবে পড়াশোনার জন্য। কিন্তু তার আগে চাকরিপ্রার্থীরা যাবেন কোথায়? সেই ব্যবস্থা কি রাষ্ট্র রেখেছে?

সদ্য পাস করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ব্যবহার করতে চান, সেটা বন্ধ করাও কি সংবেদনশীল কাজ? ওই শিক্ষার্থী তো চুরি করতে যাননি, ব্যাংক লুট করতে যাননি, প্রশ্ন-ফাঁস করতে যাননি। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা একজন শিক্ষার্থী চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পড়াশোনা করতে চান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্রের উচিত তার জন্য উপযুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা।

এবার একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ২০২২ সালে আমার স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার জন্য সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেবার আগস্টের ১১ তারিখ গিয়েছিলাম কুইন্সল্যান্ড স্টেট লাইব্রেরিতে। কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ব্রিজবেন। শহরটি ব্রিজবেন নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মাঝখানে নদী। দুই পাড়ে আধুনিক শহর। ব্রিজবেন শহরের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি জায়গা কালচারাল সেন্টার, যা শহরের মূলকেন্দ্র সিটি সেন্টারের বিপরীতে শহরের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত।

এই কালচারাল সেন্টারে রয়েছে কুইন্সল্যান্ড আর্ট গ্যালারি, জাদুঘর, পার্ফর্মিং আর্ট সেন্টার ও কুইন্সল্যান্ড স্টেট লাইব্রেরি। দুপুর ৩টার দিকে প্রবেশ করি লাইব্রেরিতে। নদীর তীরে ছিমছাম, আধুনিক ভবন। নিচতলায় অভ্যর্থনা কেন্দ্র। সেখান থেকে কিছু তথ্য নিয়ে চলে গেলাম মূল লাইব্রেরিতে। দোতলায় পড়ার জায়গা। সারি সারি বই। পড়ার টেবিল, টেবিল ল্যাম্প। ভিনদেশি নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও খুবই বন্ধুবৎসল এক সাহায্যকারী সাহায্যে মাত্র ১০ মিনিটেই পেয়েছিলাম লাইব্রেরি কার্ড।

এরপর লাইব্রেরি ঘুরে দেখেছিলাম। পিনপতন নীরবতা। সবাই জ্ঞান চর্চায় মগ্ন। দ্বিতীয়তলায় লাইব্রেরির মূল ফ্লোরের সঙ্গে ঝুলন্ত বারান্দা, যা চলে গেছে ব্রিজবেন নদীর ওপর। বড়সড় ড্রয়িংরুমের মতো জায়গা। সেখানে একজন তরুণ শিক্ষার্থী সোফায় আরাম করে ঘুমোচ্ছেন। পাশে অন্য সোফায় শরীর এলিয়ে ব্রিজবেন নদী আর নদীর অন্য প্রান্তের শহরের শোভা দেখছেন আরেকজন। একেবারেই ছবির মতোন।

ব্রিজবেন শহরে আমি যতগুলো সুন্দর জায়গা দেখেছি তার মধ্যে লাইব্রেরি ভবন থেকে নদী আর শহরের দৃশ্য আমার কাছে সবচেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক, মনোরম মনে হয়েছে। একই ধরনের আরামদায়ক, মনোরম বিশ্রাম করার জায়গা আমি দেখেছি ব্রিজবেন সিটি কাউন্সিল লাইব্রেরিতে। এই লাইব্রেরি শহরের পূর্বে টুয়ং নামের একটি জায়গায় বড় শপিংমলে অবস্থিত। স্কুল-কলেজ ফেরত ছেলে-মেয়েরা এখানে অর্ধশোয়া হয়ে বই পড়ে। কেউবা ঘুমায়। কেউবা হেডফোন কানে গুজে গান শোনে।

রাতারাতি হয়তো ঢাকা শহরের গ্রন্থাগার ও পড়ার ব্যবস্থা ব্রিজবেনের মতো আধুনিক হবে না। আবার বাংলাদেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যাও একটা বড় বাধা। কিন্তু তাই বলে, যারা বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির জন্য পড়তে চান, তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়। বরং তাদের সুযোগ করে দেওয়া উচিত।

এমনকি যারা সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছেন, তাদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

পুনশ্চ: শিক্ষার্থীরা কেন শুধু চাকরির পড়াশোনা করছেন, সেটাও অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। সেই আলাপ আরেকদিন।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

2h ago