ভয়ংকর সুন্দর ও মিথ্যার মায়াজাল

হাড় কাঁপানো হিম শীতল বৃষ্টি, সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া। জোয়ারের জোরে আরও শক্তিশালী হয়ে বেড়িবাঁধে ছোবল মারছে রিমালের উন্মত্ত জলরাশি। নড়বড়ে নিচু বেড়িবাঁধ পেরিয়ে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। এরমধ্যেই কয়েকজন এলাকাবাসী আর স্বেচ্ছাসেবী বাঁধ রক্ষায় চালিয়ে যাচ্ছেন এক 'ব্যর্থ' চেষ্টা। যদিও ঝড়ের মুখে তাদের প্রচেষ্টা খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। প্রকৃতির রুদ্ররোষে মানুষ যে কতটা অসহায়, তারই জীবন্ত দৃশ্য এক ক্লিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ফটোসাংবাদিক হাবিবুর রহমান। খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদী তীরের এই সংবাদচিত্রটি ঘূর্ণিঝড় রিমালের। যাতে এরইমধ্যেই ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা।

প্রচণ্ড গরমে টানা বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় রিমালের কালভৈরব রূপ ঢাকাবাসীর পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যদিও ২৮ মে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত আট কলামের সংবাদচিত্রটি বুঝিয়ে দিয়েছে কতটা শক্তিশালী, নির্মম ছিল এই ঘূর্ণিঝড়টি। যার ক্ষতচিহ্ন ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দুর্যোগে ২০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ধ্বংস হয়েছে ২৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ক্ষতিগ্রস্ত দেড় লক্ষাধিক ঘরবাড়ি। ভেসে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর। মারা গেছে সুন্দরবনের অগণিত বন্যপ্রাণী।

আট কলামজুড়ে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই অসম লড়াইয়ের আইকনিক সংবাদচিত্রটি ২৮ মে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটের দিকে তোলা। এই ভয়ংকর সুন্দর ছবিটি তুলতে ওই বেড়িবাঁধে ফটোসাংবাদিক হাবিবুর রহমানকে প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে ওই এলাকায় তিন ঘণ্টা টিকে থাকতে হয়েছে। অতি সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করতে হয়েছে ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি।

বহুদিন পর ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় দুর্যোগের একটা আইকনিক আলোকচিত্র দেখে ভালো লাগছিল। যদিও বিষয়বস্তু নিরিখে এটা ভালো কিছু নয়। প্রচণ্ড ঝড়ে, পানির তোড়ে ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, গৃহপালিত পশু-পাখি ভেসে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই এটা জীবন সংহারী ভয়াবহ দুর্যোগ। সেই অবর্ণনীয় দুর্দশার ছবি নিশ্চয়ই ভালো কিছু হতে পারে না। যদিও সেই দুর্যোগের যথাযথ ছবি কর্তৃপক্ষের টনক নড়াতে পারে, দুর্যোগের তীব্রতা বোঝাতে সহায়ক হতে পারে। তাই দুর্যোগের ভয়াবহতা বোঝাতে মানসম্মত আকর্ষণীয় আলোকচিত্র যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি সেটির যথাযথ ট্রিটমেন্টও জরুরি।

পাতাজুড়ে কপোতাক্ষ নদী তীরের সেই ভয়াবহ সুন্দর ছবিটি দেখে ফোন করেছিলাম ডেইলি স্টারের খুলনা বিভাগের ফটোসাংবাদিক হাবিবুর রহমানকে। তিনি জানালেন, রিমাল আঘাত হানার দিন খুলনা শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ওই বেড়িবাঁধে পৌঁছান। জানতেন, দুর্যোগে অন্য কোনো যানবাহন পাওয়া যাবে না। তাই তীব্র বাতাসের মধ্যে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলে করে তিনি সেখানে যান। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ছবি তোলার জন্য এই জায়গাটিকে ঠিক কীভাবে নির্বাচন করেছিলেন? জানালেন, রিমালের গতিপথ বিভিন্ন অ্যাপে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাতে তিনি দেখেছিলেন ঝড়টির মূল কেন্দ্র এই পথে ভূভাগে প্রবেশ করতে পারে। আর এই বেড়িবাঁধটি কয়রা উপজেলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোনো কারণে এই প্রতিরোধ ভেঙে গেলে কয়রা শহর ও অন্যান্য লোকালয় মুহূর্তে তলিয়ে যাবে। সে কারণেই তিনি এই জায়গাটি নির্বাচন করেছিলেন।

সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের রিপোর্টিং কোর্সে একটা অবশ্য পাঠ্য বইয়ের নাম দ্য কমপ্লিট রিপোর্টার। এই গ্রন্থে সংবাদ ছবি নিয়ে একটি আলোচনা আছে। তাতে বলা হয়েছে, 'পিকচার ইজ অ্যা ভাইটাল পার্ট অব দ্য মডার্ন নিউজপেপার। দে টেক দ্য প্লেস অব মেনি ওয়ার্ডস ইন পোট্রেয়িং দ্য ডেস নিউজ। পিকচার্স স্পিক কুইকলি, ভিভিডলি, সিম্পলি অ্যান্ড দে গিভ দ্য নিউজপেপার অ্যা মোর কালারফুর অ্যান্ড মোর রিলায়েবল টাইপোগ্রাফিক অ্যাপারেন্সেস।' একটা ভয়াবহ দুর্যোগের মাত্রা অতি দ্রুত, অতি সাধারণভাবে তুলে ধারার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালাম ফটোসাংবাদিক হাবিবুর রহমানকে।

এবার আসা যাক ভিন্ন প্রসঙ্গে। রিমাল নিশ্চিতভাবেই বড় মাত্রার দুর্যোগ। খুব বেশি প্রাণহানি না হলেও এর অর্থনৈতিক ক্ষতি যে ব্যাপক—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানার পর থেকেই এ সংক্রান্ত সংবাদ, ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডিং হিসেবে ছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে কিছু পুরোনো বা ভুয়া তথ্যও। বিশেষ করে এআই দিয়ে তৈরি ঝড়ের কৃত্রিম রূপের আকর্ষণীয় ছবি অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন কোনো ধরনের তথ্যসূত্র উল্লেখ করা ছাড়াই। যাতে ব্যাপক বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

এ ছাড়া ভাঙা ঘরের নিচে, কাদা পানির মধ্যে একজন মা তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন এমন ছবিও বেশ ভাইরাল হয়। ছবিটি নিশ্চিতভাবেই খুবই সংবেদনশীল। যে কাউকে আহত ও প্রভাবিত করে। কিন্তু দেখা গেল এটা রিমালের ছবি নয়। এটা একটি ভুয়া ছবি। এ রকম অনেক ভিডিও ছড়িয়েছে সাইবার পরিসরে। যা রিমাল সম্পর্কিত নয়। যাতে তৈরি হয়েছে সংশয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া নিয়ে বিস্তারিত কাজ করছে ইউনেস্কো। তাদের 'জার্নালিজম, ফেক নিউজ অ্যান্ড ডিসইনফরমেশন' শিরোনামের একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ, দুর্বিপাক, রাজনৈতিক আন্দোলনে ভুয়া তথ্য খুব বেশি ছড়ায়। যাতে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে তথ্য মহামারি বা ইনফোডেমিক নামে।

রিমাল বা যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তথ্য (ছবি, ভিডিও, গ্রাফিক্স, অডিও) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করার আগে সতর্কতা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে আমরা যে পিছিয়ে আছি, সে কথা বলাই বাহুল্য। মিথ্যার মায়াজালে আটকে পড়া নয়, একজন নেটিজেন হিসেবে আমাদের উচিত আরও সতর্ক থাকা, আরও দায়িত্বশীল আচরণ করা।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Tk 707cr spent in 9yrs, dengue still ravages Dhaka

Despite spending around Tk 707 crore over the past nine years, Dhaka’s two city corporations have failed to shield residents from the relentless surge in dengue and other mosquito-borne diseases.

8h ago