‘আমাকে হত্যা করলে, বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব’

সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত আবু সাঈদ ও তার ফেসবুকের শেষ পোস্ট। ছবি: সংগৃহীত

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আবু সাঈদ যখন একা বুক পেতে দাঁড়ান, তিনি হয়ত ভাবছিলেন পুলিশ গুলি চালাবে না, চালাতে চাইবে না। হয়ত ভাবছিলেন, এই স্বাধীন বাংলায় কার এমন সাধ্য এই তরুণের বুকে গুলি চালায়। কিংবা সাঈদ হয়ত ভেবেছিলেন প্রাণ গেলে যাবে, যাক এই বাংলার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য। প্রাণ গেলে যাক, আমি বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াই। বুক পেতে সামলে দেই বাকিসব সহযোদ্ধাদের।

এই ভেবেই হয়ত পুলিশের ছোড়া একের পর এক গুলি সামলেও শক্ত পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন আবু সাঈদ। যখন আর পারছিলেন না, ঠিক যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন তখন হয়ত নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার মতো ভাবছিলেন, 'আমাকে হত্যা করলে, বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব।'

এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। জানা যাবে না কী চিন্তা চলছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মাথায়। শুধু জানা গেল, দুপুর আড়াইটায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। 

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্কের মোড় এলাকায় গতকাল ঘটে যাওয়া এই ঘটনা যখন গণমাধ্যমগুলো নিশ্চিত করতে ব্যস্ত, তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে এল, বারুদ বুকে জেগে এই তরুণের মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য।

আমাদের মতো দূরে বসে থাকা নেটিজেনদের জন্য এ দৃশ্য বড়ই করুণ ও হৃদয়স্পর্শী। এ দৃশ্য সাঈদের সহপাঠীদের চোখে তীব্র বেদনার। এ দৃশ্য সাঈদের বাবা-মায়ের মায়ের জন্য হাহাকারের। 
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সংস্কার আন্দোলনে স্লোগান দেওয়া লাখো তরুণের শূন্য হৃদয়ে এ দৃশ্য বসন্তের শুকনো পাতায় জ্বলা তীব্র আগুন। আর এই আগুনে ফুঁসে উঠতে দেখা গেছে ঢাকাসহ সারাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের। 

পুলিশের গুলিতে সাঈদ হত্যার খবরে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ এলাকায় এ ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল ও সমাবেশ করতে দেখা যায়।

সোমবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে, কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি দেয়।

নির্ধারিত কর্মসূচি সেইসঙ্গে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে হলগেটের তালা ভেঙে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী পুরো ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য

অথচ একদিন আগেই, মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রত্যেক হলে গিয়ে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধামকি দিয়েছে। আর একদিন ব্যবধানে চিত্র পাল্টে যায়। শিক্ষার্থীদের প্রাণ সঞ্চার করে নবারুণের এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না কবিতার আরও এক লাইন, 'হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইন্টারোগেশন মানি না।'

শিক্ষার্থীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা, তাদের ধাওয়া দিয়ে পুরো ক্যাম্পাস দখলে নেওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাটির প্রদীপে হয়ত এভাবেই শিখা হয়ে জ্বলেছিলেন আবু সাঈদ।

এদিন শুধু রাজধানী ঢাকাতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ, সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় ২৯টি পয়েন্টে জমায়েত করে বিভিন্ন মোড় ব্লক করে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়।

এদিন ঢাকা, রংপুরসহ সারাদেশে সংঘর্ষে অন্তত ৬ তরুণ-যুবার প্রাণহানি ঘটে, আহত হয় অন্তত কয়েকশ, যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। সারাদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘর্ষের পর অবশেষে রাত ৯টার দিকে পুরোপুরি শান্ত হয় সব ক্যাম্পাস।

এদিকে, মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা ঘটায় চমকপ্রদ এক ঘটনা। আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী ছাত্রীদের তোপের মুখে পড়ে হল শাখা ছাত্রলীগের নেত্রীরা৷ তাদের অবরুদ্ধ করে মারধরও করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সহযোগিতায় ১০ নেত্রীকে হল থেকে বের করে আনা হয়।

পরে শিক্ষার্থীরা হল প্রভোস্টকে দিয়ে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেয় এই বলে যে, 'আজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে সকল ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো।'

রোকেয়া হলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের অন্যান্য হলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা একইভাবে একই ধরনের ভাষায় লেখা চিঠিতে নিজ নিজ হলের প্রভোস্টদের স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই কার্যক্রম যেন নবারুণের কবিতার ওই লাইনটার মতো, 'তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি, বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে, গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।'

যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবু সাঈদের প্রতি উৎসর্গ করে বলছে, প্রিয় সাঈদ, 'বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে (তুমি) ফিরে আসব (আসবে), আমার (তোমার) বিনাশ নেই; সুখে থাকব (থাকবে), দুঃখে থাকব (থাকবে) সন্তান-জন্মে সৎকারে, বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন, মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।'

আরাফাত রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। সাক্ষী হয়েছিলেন, এ আন্দোলনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হামলার। প্রত্যক্ষ করছেন ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনও।

 

Comments

The Daily Star  | English
soybean oil price hike

Soybean oil price hike temporary: commerce adviser

Improved supply and increased competition will help bring down prices soon, he says

1h ago