সাঈদ, আপনিই আমাদের জোহা স্যার!

কোনো শিক্ষক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক কেউই ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। এই অভাববোধ, ক্ষেদ থেকেই সাঈদ যেন নিজেই হয়ে উঠলেন একজন শামসুজ্জোহা।

আবু সাঈদ, মারা যাওয়ার আগে গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন জোহা স্যারের অভাব। কায়মনে চেয়েছিলেন উনার উপস্থিতি। মৃত্যুর আগের দিন ফেসবুক পেজে লিখেছিলেন, 'স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার।'

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি এই ছাত্র মৃত্যুর আগে হন্যি হয়ে তালাশ করেছিলেন একজন শামসুজ্জোহাকে, কেন? কারণ, উনার প্রত্যাশা ছিল, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কেউ একজন রচনা করবেন নতুন ইতিহাস। হয়ে উঠবেন এই সময়ের জোহা স্যার! আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন, ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো যাবে না, যদি চালানো হয়, তা হবে আমার রক্তের ওপর দিয়ে।

'৬৯-র অভ্যূত্থানের সময় যেমনটা বলেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক প্রক্টর মুহম্মদ শামসুজ্জোহা।

কাঙ্ক্ষিত একজন স্যারের দেখা পাওয়ার জন্য আবু সাঈদ আপনি-আপনারা অধীর আগ্রহে পার করেছেন একটা পক্ষ। কী কষ্টের সেই দিনগুলো! প্রতীক্ষার একটা পক্ষ হয়েছে এক বছরের চেয়েও দীর্ঘ, কিংবা তারও অধিক। তারপরও, অপেক্ষা করেছেন, প্রতীক্ষার প্রহর গুণেছেন, এক বুক আশা নিয়ে।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন! তাই, একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছেন নিজের আকুতি। মেলে ধরেছেন আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার বারতা। লিখেছেন, 'স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার।'

কিন্তু না, সেই স্ট্যাটাসেও সাড়া মেলেনি কারও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, দেখা মেলেনি সাঈদের-ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষিত শামসুজ্জোহা স্যারের। কোনো শিক্ষক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক কেউই ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। এই অভাববোধ, খেদ থেকেই সাঈদ যেন নিজেই হয়ে উঠলেন একজন শামসুজ্জোহা। রচনা করলেন অমর এক ইতিহাস। যে ইতিহাস আমাদের স্মরণ করাবে ৯০, ৮৭, ৭১, ৬৯, ৫২-র রক্তঝরা দিনগুলোর মতো ২০২৪ কেও।

মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাঈদ থাকবেন অনুপ্রেরণার দীপশিখা হিসেবে। কেবল বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর যে প্রান্তে ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া ও অধিকারের প্রসঙ্গ হাজির হবে, সেখানে দ্ব্যার্থহীনভাবে উচ্চারিত আবু সাঈদের নাম।

শামুসুজ্জোহা স্যারকে সাঈদ যেহেতু গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন, এ কারণে উনার জানা ছিল নিশ্চয় জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের কথা। ডায়ারের নির্মম-নির্দয় গুলিবর্ষণে অগণন হতাহতের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যাখান করেছিলেন ব্রিটিশের দেওয়া নাইটহুড উপাধি। সাঈদের আত্মাহুতির সাহস দেখে ইতিহাস সচেতন সকলেরই মনে পড়বে নিশ্চয় ক্ষুদিরামের কথা।

সাঈদ, আমাদের বিশ্বাস, আপনার ও আপনাদের মতো ছাত্রদের ভেতরেই বেঁচে থাকেন একজন নূর হোসেন, একজন রুমি, একজন আসাদ, একজন রফিক-শফিক-বরকত-জব্বারের মতো অগণন সব সাহসী প্রাণ। যারা জীবন বিসর্জন দেন দেশপ্রেম থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায়। যাদের চাওয়া ছিল কেবল একটাই—মানুষের মুক্তি-স্বস্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা।

যেমনটা চেয়েছিলেন আপনি ও আপনারা। যার নাম কোটা সংস্কার। কারণ, কোটার নামে সরকারি চাকরির অর্ধেকেরও বেশি দখলে নিয়েছিল অন্যায় অপকর্মের হোতারা।

বেশিরভাগ কোটা যে লক্ষ্যের জন্য রাখা হয়েছিল, তা তো বাস্তবায়ন হচ্ছিলই না, উপরন্তু সেসবে বাসা বেঁধেছিল সকল প্রকারের ধান্ধা-ফিকির আর দুর্নীতির আগাপাছতলা। কোটার ৩০ ভাগ বরাদ্দ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য। এসব যে স্বচ্ছভাবে হচ্ছিল না, তার বড় প্রমাণ সনদধারী ৬২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি। অন্যের সন্তানকে নিজের পরিচয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কোটায় চাকরি নেওয়ার মতো অপরাধ।

এসব গুরুতর অন্যায়-অপকর্মের অবসান চেয়েছিলেন আপনারা। এ জন্যই নেমে ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে। চাকরির বাজারের এই হাহাকারের দিনে, যেখানে এক কোটি ৮০ লাখ বেকার ধুঁকছে চাকরির অভাবে, যেখানে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলেছে সঙ্গিন ও জীবন্মৃত, যেখানে শাসক ও প্রশাসকরা কেবলই স্বার্থ দেখছে উপরমহল ও নিজ বৃত্তের ঘেরাটোপে—সেখানে কোটা সংস্কার চাওয়া কি অন্যায় কিছু? মানুষ কি বেঁচে থাকার জন্য শেষ অধিকার হিসেবে এটুকুও চাইতে পারবে না?

সাঈদ ও তার সতীর্থদের চাওয়া ছিল একেবারে যৎসামান্য। সেখানেও যখন তারা হতমান হয়েছেন, নির্দয় নিষ্পেষণের শিকার হয়েছেন, তকমা পেয়েছেন বিশেষ বিশেষ শব্দের; বিপরীতে অবিশ্বাস্যভাবে পাশে পাননি কাউকেই; তখনই সাঈদ মনের ভেতরের আকাঙ্ক্ষাটাকে, একজন জোহা স্যারের প্রত্যাশাকে লিখে দিয়েছেন ফেসবুকের পাতায়।

তারপর, এক বুক বেদনা ও হাহাকার নিয়ে দেখেছেন, এ সময় কেউ হতে চান না একজন শামসুজ্জোহা। কারণ, আখের গোছানোর সুবর্ণসময় এখনই বুঝি বয়ে যায়!

কেনো সাঈদ একজন শামসুজ্জোহাকে গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন? কারণ তিনি জানতেন শামসুজ্জোহারা ন্যায় ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শক্তি যোগায়। যেমনটা করেছিলেন ১৯৬৯-এ। শেখ মুজিব তখনও বঙ্গবন্ধু না হলেও বাঙালির, সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সবার চাওয়া হয়ে উঠেছিল একটাই, 'জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো'।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি তিনি। এই মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ৬৯-র শুরুতেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পুরো দেশ। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদ। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে গড়ে তোলে দুর্বার এক গণ-আন্দোলন। মুহূর্তেই আইয়ুব গেটের নাম বদলে রাখা হয় 'আসাদ গেট'।

আন্দোলন পরিণত হয় গণসংগ্রামে। ইতিহাসে এরকম গণঅভ্যূত্থানের কথা শোনা যায় চৈতন্যর সময়ে। সেই আন্দোলন সংগ্রামে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছিল ঘরে ঘরে 'অরন্ধন' কর্মসূচি পালনের মধ্যে দিয়ে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের কালেও পালিত হয়েছিল এরকম এক 'অরন্ধন' প্রতিবাদ।

১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হলে নিহত হয় মতিউরসহ আরও কয়েকজন ছাত্র। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর নিহত হন তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক। এই অবস্থায় আন্দোলন হয়ে ওঠে লক্ষ্যভেদী। ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে নৃশংসভাবে দমন-পীড়ন ও ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদ লেখক-কবি-সাহিত্যিকেরা ফিরিয়ে দিতে থাকেন পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সিতারা-ই-ইমতিয়াজসহ অন্যান্য পুরস্কার। ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন চলাকালে পুলিশি হামলায় আহত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভরত ছাত্ররা।

বাংলাপিডিয়ায় এ সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে, 'পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। স্থানীয় প্রশাসন ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে ১৪৪ ধারা জারি করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সামরিক বাঁধা উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ড. জোহা অকুস্থলে ছুটে যান এবং উত্তেজিত ডরমিটরিতে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালান। তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি না চালানোর অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করে সেনাবাহিনী মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ করে এবং ড. জোহা গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পূর্বে ড. জোহা তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। যদি গুলি করা হয় তবে কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে।" ড. জোহা তাঁর কথা রেখেছিলেন।'

সাঈদ, আপনিও কথা রেখেছেন, স্বপ্ন পূরণ করেছেন। আপনার প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি পূর্ণ মযাদা দিয়েছেন। এই বিবেকভূক সময়ে যখন দেখেছেন কেউ জোহা স্যার হতে চান না, তখন আপনিই হয়ে গেলেন একজন জোহা স্যার। আমরা দেখলাম, দেখল বাংলাদেশ ও পৃথিবী নামক এ গ্রহের তাবৎ মানুষ। কী অসীম সাহসিকতায় আপনি বুক টান টান করে দাঁড়ালেন পুলিশের বন্দুকের নলের মুখে। আপনার চোখে মুখে তখন অপূর্ব এক প্রত্যয় ও প্রতীতি।

যে পুলিশ আপনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে সে তখন আপনার প্রিয় ক্যাম্পাসে। আর আপনি তখন ক্যাম্পাসের বাইরে। এ যেন আপন গৃহে পরবাসী! যে ক্যাম্পাসে একজন পুলিশের প্রবেশ করতে হলে অনুমোদন লাগে প্রক্টর-ভিসির, সেই ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে আপনাকে গুলি করা হচ্ছে। আপনার মনে আছে সাঈদ, ব্রিটিশেরা একবার ভারত রক্ষা আইন করেছিল! কী বিচিত্র এই দেশ, কত অদ্ভুত এই সময়!

সাঈদ, আমাদের কেবল একটাই জিজ্ঞাসা, আপনাকে গুলি করার অনুমতি কোথায় পেল ওই পুলিশ? কে বা কারা দিল এই অনুমোদন। তার কোনো উত্তর নেই কারও কাছে। কোনোদিন পাওয়া যাবে বলেও প্রতীতি রাখা দুরুহ।

আপনি তখন নিরস্ত্র, সাঈদ। হাতে মামুলি একটা লাঠি, যা দিয়ে কুকুরকে ভয় দেখানোও দুরুহ। আপনি তখন স্থির। দৌড়ানো বা পালিয়ে যাওয়ার কোনো চেষ্টা নেই আপনার ভেতরে। কাউকে আক্রমনের লক্ষণ নেই দেহ ভঙ্গিমায়। তবুও আপনাকে গুলি করা হলো। একটা নয়, একাধিক। ঠাণ্ডা মাথায়। আপনার বুক বরাবর তাক করে।

ইতিহাসের গতিপথের কী সাংঘাতিক মিল! জোহা স্যারের আত্মাহুতির মধ্যে দিয়ে সেদিনের গণঅভ্যূত্থান তার লক্ষ্যে পৌঁছায়। প্রত্যাহার হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসভায় শেখ মুজিবকে দেওয়া হয় 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি। সেই থেকে মুজিব ভাই হয়ে উঠলেন 'বঙ্গবন্ধু'। পতন হল আইয়ুবশাহীর।

যার ধারাবাহিকতায় এলো ৭০'র সাধারণ নির্বাচন এবং ৭১'র স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ।

সাঈদ, আপনার মৃত্যুতে ঘুম ভাঙে আমাদের শিক্ষক সমাজের। আপনার মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পালন করেন প্রতিবাদ কর্মসূচি। সংখ্যায় অল্প। কিন্তু আপনি তো জানেন সাঈদ, ভালো কাজে, শুভ কোনো উদ্যোগে সবসময় অল্পসংখ্যক মানুষ থাকে। জোহা তো সবাই হন না। একজন হন।ৎ

১৯৬৯ সালে যারা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উনাদের ক'জনকেই বা আমরা স্মরণে রেখেছি? আপনিই তো লিখেছিলেন সাঈদ, 'আপনার (মুহম্মদ শামসুজ্জোহ) সমসাময়িক সময়ে যাঁরা ছিলেন, সবাই তো মরে গেছেন, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। এই প্রজন্মে যাঁরা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একদিন একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছেন, মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান ও শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে। অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।'

সাঈদ, আপনার মৃত্যু আমাদের জন্য অসীম বেদনার। আমরা কেউই আটকাতে পারিনি চোখের জল। কেবলই একটা প্রশ্ন আমাদেরকে তাড়িত করেছে, জোহা স্যার না হয় শহীদ হয়েছিলেন পরাধীন দেশে। উনাকে গুলি করেছিল পাঞ্জাবি এক জওয়ান। আর আপনি মারা গেলেন স্বাধীন দেশে। যে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিল ত্রিশ লাখ শহীদ। আপনাকে গুলি করেছে কোনো পাঞ্জাবি জওয়ান নন, বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় কথা বলা একজন পুলিশ—যার বেতন হয় আপনার-আমাদের দেওয়া করের টাকায়। যার পোশাকে লেগে রয়েছে আপনার বাবার শ্রমের ঘাম।

সাইদ, আপনি লিখেছিলেন, 'একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।' আপনার সাহসী এই উচ্চারণকে আমরা কুর্ণিশ জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, আপনার মৃত্যুও এই ঘুমকাতুরে জাতির জন্য অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের। আপনার সাহসী মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সরকারি চাকরির কোটা বিধিতে বৈষম্যের অবসান হয়েছে, ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন আপনি ও আপনারা।

১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক শিক্ষকসভায় মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা বলেছিলেন, 'আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।' এর পরদিনই বীরোচিত এক মৃত্যু হলো জোহা স্যারের। কী অবাক করা বিষয়! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরদিন একইভাবে সাঈদ আপনিও হয়ে গেলেন ২০২৪ সালের একজন জোহা স্যার।

আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চেনা-অচেনা সকলেই কাঁদছেন আপনার জন্য। যে কান্না একদিন থেমে যাবে নিশ্চয়। কিন্তু, আপনার বীরোচিত আত্মত্যাগ কখনও ভোলা যাবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবহমান থাকবে সেই ইতিহাস। আপনি কেবল বাংলাদেশ নামক ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের গর্ব নয়, এ পৃথিবীরও গর্বের প্রতীক। কারণ এ পৃথিবী আপনার মতো একজন সাহসী সন্তানের জন্ম দিয়েছিল।

কেবল বাংলা ভাষায় নন, অন্যান্য ভাষাতেও স্মরিত হবেন আপনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিরা আপনাকে নিয়ে লিখবেন অমর কাব্যের অমর কবিতা। আপনি এ গ্রহের ইতিহাসে সংযোজন করেছেন অধিকার আদায়ের নতুন এক অধ্যায়, স্বাতন্ত্র্যধর্মী একমাত্রা; যা অতীতে ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে করা দুরুহ।

সাঈদ, আপনার বীরগাঁথায়, আপনি বেঁচে থাকবেন কাল থেকে কালান্তরে; অমর কাব্যের অমর কবি হয়ে।

কাজল রশীদ শাহীন: চিন্তক, সাংবাদিক ও গবেষক।

[email protected]

Comments