বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার

দুপুর ২টার পরে রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও রামপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার যে উল্লাসের চিত্র টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাচ্ছিলো, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের দাবি পূরণ হয়ে গেছে অথবা তারা এরইমধ্যে সংবাদটি জেনে গেছেন।
গণ-আন্দোলন
ঢাকায় ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের একাংশ। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলে যাবে এবং সরকার পতনের আন্দোলনটি এত দ্রুত সফল হয়ে যাবে, সেটি হয়তো আন্দোলনকারীরাও ভাবেননি। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, দেশব্যাপী যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, যেভাবে শত শত মানুষ নিহত হচ্ছিলো, তার ধারাবাহিকতায় দেশে হয়তো জরুরি অবস্থা জারি হবে এবং বিক্ষুব্ধ মানুষ সেটিও ভেঙে ফেলবে এবং তারপরে হয়তো আরও রক্তপাত ও প্রাণহানির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতাগ্রহণ করবে। তারপর হয়তো নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার গঠিত হবে।

কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেলো, আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণাকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক যেদিন 'বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রূপান্তরের রূপরেখা প্রস্তাব' দিলো, তার পরদিনই এই ঘটনাটি ঘটলো—যে প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি জানানো হয়েছিল।

৫ আগস্ট সোমবার ছিল আন্দোলনকারীদের ঢাকা মার্চ কর্মসূচি। সকাল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছিলো। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে দুপুর ২টার দিকে এটি মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ—সেটি পূরণ হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে যখন জানানো হলো যে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন।

দুপুর ২টার পরে রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও রামপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার যে উল্লাসের চিত্র টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাচ্ছিলো, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের দাবি পূরণ হয়ে গেছে অথবা তারা এরইমধ্যে সংবাদটি জেনে গেছেন।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগ বাদে দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল—যেমন: বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এমনকি সরকারের নির্বাহী আদেশে সম্প্রতি নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতের আমিরও এই বৈঠকে ছিলেন বলে তিনি জানান। সেইসঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক আসিফ নজরুলও ছিলেন।

বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে সংসদ সদস্যদের বাইরে থেকে অন্য কাউকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুযোগ না থাকলেও রাষ্ট্রপতি তার বিশেষ ক্ষমতাবলে যদি কোনো অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন, তাহলে নির্বাচনের পরে সংসদের প্রথম অধিবেশনে সেটি অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। এরকম পরিস্থিতিকে বলা হয় 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি'।

সংবিধানের জন্য দেশ নয়, বরং দেশের জন্য সংবিধান। অতএব কোনো এক সংকটময় মুহূর্তে যদি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, সেখানে সংবিধানের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় দেশ ও দেশের মানুষের নিরাপত্তা।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ বন্ধুবৎসল। এখানে পারিবারিক কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী। একই পরিবারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি এমনকি ইসলামি দলের অনুসারী আছেন। সুতরাং দিন শেষে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আত্মীয়, বন্ধু, পরিজন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে বছরের পর বছর ধরে দেশে যে ব্যক্তি আক্রমণ হয়েছে, সেটির পুনারবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সেনাপ্রধান যে বার্তাটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন তা হলো, প্রতিটি হত্যার বিচার করা হবে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের কেউ যাতে আর কোনো ধরনের হামলা-ভাঙচুর বা সংঘাতে না জড়ান। সবাই যেন শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন।

কিন্তু দেখা গেলো, পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার সংবাদ শোনার পরপরই গণভবনে হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েছেন। যে দৃশ্য দেখা গিয়েছিল শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের পরে। যদিও প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। হুবহু সেরকম না হলেও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার সংবাদ শোনার পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন যেভাবে গণভবনে ঢুকে গেছে—তার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার রাজপ্রাসাদ দখলের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তবে এটি নিশ্চয়ই কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে রাজধানীর বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে কিছু ক্ষুব্ধ জনতা। এটি পুরো জাতির জন্য লজ্জার। রাজনৈতিক মতভিন্নতা বা মতবিরোধের অর্থ এই নয় যে, সবকিছু ভেঙে ফেলতে হবে, সব স্থান ও স্থাপনায় আঘাত হানতে হবে। এটি কোনো সভ্য আচরণ নয়।

গণভবনে ঢুকে চেয়ার টেবিল এবং ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে নিয়ে যাওয়ার যে দৃশ্য টেলিভিশনের খবরে দেখানো হয়েছে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত। সুতরাং কেউ যাতে প্রতিহিংসার পথে পা না বাড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।

মনে রাখতে হবে, আজকে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একটি সরকারের পতন হলো যেসব কারণে, তার অন্যতম এই প্রতিহিংসা এবং বিরোধী মত ও আদর্শকে ন্যূনতম জায়গা না দেওয়া; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলই শুধু নয়, বরং নির্দলীয় লেখক-সাংবাদিক-নাগরিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের দমনের চেষ্টা করা; তাদেরকে শত্রু বিবেচনা করে কণ্ঠরোধ করা। সুতরাং নতুন সরকারের আমলে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়; বিপক্ষে কথা বললেই বা লিখলেই যেন তাকে শত্রু বিবেচনা করে প্রতিহত করার চেষ্টা করা না হয়—সে বিষয়ে সবার সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।

নতুন সরকারের উচিত হবে সকল রাজনৈতিক মত ও পথের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সারা দেশে এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে যে, কেউ যেন ভিন্ন মত ও আদর্শের কারণে আক্রমণের শিকার না হন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যাতে আক্রমণের শিকার না হন, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি উৎসাহী যেসব কর্মকর্তা নিজেদের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, প্রচলিত আইনেই তাদের বিচার হোক। তারা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন এবং দেশে থাকলেও তাদের ওপর যেন কোনো ধরনের আক্রমণ চালানো না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ বন্ধুবৎসল। এখানে পারিবারিক কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী। একই পরিবারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি এমনকি ইসলামি দলের অনুসারী আছেন। সুতরাং দিন শেষে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আত্মীয়, বন্ধু, পরিজন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে বছরের পর বছর ধরে দেশে যে ব্যক্তি আক্রমণ হয়েছে, সেটির পুনারবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মনে রাখা দরকার, দেশটি আওয়ামী লীগের যেমন নয়, তেমনি বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি কিংবা কোনো বাম দলেরও নয়। দেশটা মানুষের। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের সকল ক্ষমতার মালিক দেশের জনগণ। সকল ক্ষমতার মালিক মানে দেশেরও মালিক।

অতএব আগামী দিনে বাংলাদেশ কেমন থাকবে সেটি নির্ভর করছে এই জনগণের আচরণের ওপর। প্রতিহিংসা বা হঠকারিতার মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। বরং সবার সংযত আচরণের মধ্য দিয়েই একটি সুন্দর, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও জনবান্ধব রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। এই সুযোগটি যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments