পুলিশের ওপর জনআস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন প্রধান কাজ

বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য ঘটনায় পুলিশের ওপর মানুষের যে অনাস্থা, অবিশ্বাস ও ভয় তৈরি হয়েছে, সেটি দূর করতে হবে। এটি একদিনে দূর হবে না। কিন্তু শুরুটা করতে হবে এখনই।

একটি বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেল। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাত মাসের মাথায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে—প্রধানত যার নেতৃত্বে ছিল দেশের তরুণ সমাজ। অনেকে এটিকে 'জুলাই বিপ্লব' হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন।

ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে এর আগে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। তবে তিনি পালিয়ে যাননি। পরবর্তী কয়েক বছর জেল খেটেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। শুধু তাই নয়, ক্ষমতারও অংশ হয়েছেন। এরশাদ পৃথিবীর সেই বিরল সামরিক শাসক, যিনি বন্দুকের নলের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দীর্ঘদিন স্বৈর শাসন চালানোর পরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও পুনরায় ক্ষমতার অংশ হতে পেরেছেন। সাধারণত অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকদের যে পরিণতি হয়, এরশাদকে সেই পরিণতি বরণ করতে হয়নি। বরং তিনি একটি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ তার বিদায়টি হয়েছে সম্মানজনক। ভবিষ্যতে এরশাদের এই উত্থান-পতন ও পুনর্জাগরণ শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সারা পৃথিবীর রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চায় হয়তো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে পঠিত হবে। সেটি অন্য প্রসঙ্গ।

সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পরে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। ৬ আগস্ট থেকে ডাকাত-আতঙ্কে মানুষের ঘুম হয় না। সব যে গুজব তাও নয়। কেননা অনেক জায়গায় সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় মানুষের হাতে অনেক অপরাধী ধরাও পড়েছে। তারা কি সবাই বিগত ১৫ বছরে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দলের নেতাকর্মী? কিছু প্রতিশোধের ঘটনা হয়তো ঘটছে। কিন্তু ডাকাতির মতো ঘটনাগুলোয় কারা জড়িত? দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট কারা করছে? তারা কি নিতান্তই দুর্বৃত্ত নাকি তাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে? তারা কি প্রতিশোধ নিতে চায় নাকি গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়? সব প্রশ্নের উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না। বরং এই মুহূর্তের প্রধান কাজ হচ্ছে নৈরাজ্য থামানো। কিন্তু সেই কাজটি কে করবে?

সেনাবাহিনীকে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। সেনাবাহিনী জাতির জরুরি প্রয়োজনে রাস্তায় থাকে। বরং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের মূল কাজ পুলিশের। তা ছাড়া ১৮ কোটি লোকের একটি দেশে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার সেনা সদস্য নামিয়েও দীর্ঘমেয়াদে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সেই কারণেই আসে পুলিশের প্রসঙ্গ। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই আতঙ্কিত। তাদের গুলিতে প্রচুর শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ নিহত হলে এর প্রতিক্রিয়ায় তারাও জনরোষে পড়ে এবং প্রচুর পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যাটি এখনো নিশ্চিত নয়। অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়ে চিকিৎসাধীন।

অসংখ্য থানায় হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রচুর অস্ত্র লুট হয়েছে। কোনো সাধারণ নাগরিক, তিনি যতই বিক্ষুব্ধ হোন না কেন, সরকারি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যাবেন না। কারণ তিনি এটির ব্যবহার করতে পারবেন না। বরং এরকম পরিস্থিতিতে প্রচুর অপরাধী, জঙ্গি ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে এসব অস্ত্র চলে গেলে সেগুলো উদ্ধার করা কঠিন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারেই বঙ্গবন্ধু সরকারকে দারুণ বেগ পেতে হয়েছিল। তখন যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাদের সবাই ছিলেন দেশপ্রেমিক। সেই দেশপ্রেমিকদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের অভিজ্ঞতাই খুব সুখকর নয়। পক্ষান্তরে এবারের অভ্যুত্থানে কী পরিমাণ সুযোগসন্ধানী লোক যে ঢুকে গিয়েছিল এবং তারা যে কী পরিমাণ অস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছে; পরবর্তীতে এর কত শতাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হবে—সেটি বিরাট প্রশ্ন। যে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হবে না, সেগুলো কাদের হাতে চলে যাবে? কারা কোন কাজে ব্যবহার করবে? অন্তর্বর্তী সরকার যদি দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়; যদি দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে না পারে, তাহলে এসব অস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হবে কি না—সেটি আরও উদ্বেগের বিষয়।

এমতাবস্থায় নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হবে সারা দেশের থানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে কী পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে এবং এর মধ্যে কোন ধরনের অস্ত্র বেশি, তার তালিকা করা। এই ডেটাবেজ পুলিশের কাছে আছে। ফলে পূর্ণাঙ্গ তালিকা করে নিকটস্থ থানায় অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়ে শক্ত ঘোষণা দিয়ে বলতে হবে যে, এই সময়ের পরে বাড়িতে বাড়িতে সেনাবাহিনী তল্লাশি চালাবে। আর যারা অস্ত্র জমা দিয়ে যাবে, তাদেরকে আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। না হলে কেউ ভয়ে জমা না দিয়ে নদী বা সমুদ্রে ফেলে দেবে। অর্থাৎ মানুষকে বোঝাতে হবে যে এই অস্ত্র দেশের জনগণের টাকায় কেনা এবং এগুলো নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হবে।

মুশকিল হলো, সাম্প্রতিক আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বেপরোয়া গুলির কারণে নাগরিকদের তরফে এই প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে যে, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় কেনা গুলি কী করে সেই জনগণের ওপর চালানো হয়? ফলে জনগণের মন থেকে এই ক্ষোভ খুব দ্রুত প্রশমন করা কঠিন। কিন্তু তারপরও একটি বড় পরিবর্তন যেহেতু হয়ে গেছে, অতএব এখন সবাইকে নিয়েই দেশ চালাতে হবে। ছোট্ট আয়তনের দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। সূর্য উঠলে সবাই সবার মুখ দেখে। ইউরোপ-আমেরিকার শীতপ্রধান দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপন নয়। এখানে ভোর হলেই লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। একজন আরেকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। দলমত নির্বিশেষে সবাই একই দোকানে চা খায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যদিও রাজনৈতিক সহাবস্থান ও সম্প্রীতিতে বড় ধরনের চিড় ধরেছে। পুরো জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এখান থেকেও বের হতে হবে। ভোটের মাঠে যার যা পরিচয় থাকুক না কেন, দিন শেষে সবাই যে সবার আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন, সেই উপলব্ধিটা জরুরি। অতএব নতুন সরকারের জন্য এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য ফিরিয়ে আনাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নৈরাজ্য থামানো। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যে ডাকাতি ও ডাকাতির আতঙ্ক; হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর সেগুলো কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি এটি যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি জরুরি আইনি পদক্ষেপ।

পুলিশের ওপর মানুষের যে আস্থা নষ্ট হয়েছে, সেটি ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কাজটি করতে হবে। পুলিশের শতভাগ সদস্য দুর্নীতিগ্রস্ত বা দলীয় ক্যাডার নন। পুলিশকেও এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট করে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করতে হবে যে, তারা দলমত নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তায় আন্তরিকভাবে কাজ করবেন। যেকোনো নাগরিক থানায় গেলে বিনা ঘুষ, বিনা হয়রানি ও কোনো ধরনের কালক্ষেপণ ছাড়াই সেবা পাবেন। কোনো ধরনের ব্ল্যাকমেইল করা হবে না। ছোটখাট অভিযোগ বা মামলার আসামি ধরার জন্য পুলিশ মধ্যরাতে কারো বাসায় হানা দেবে না।

বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য ঘটনায় পুলিশের ওপর মানুষের যে অনাস্থা, অবিশ্বাস ও ভয় তৈরি হয়েছে, সেটি দূর করতে হবে। এটি একদিনে দূর হবে না। কিন্তু শুরুটা করতে হবে এখনই। পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে। শুধু আইজিপি বা কমিশনাররা নন, বরং প্রতিটি থানার ওসিকে এই ঘোষণা দিতে হবে এবং সেটি বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। মানুষকে আস্থায় নিতে হবে।

নাগরিকদেরও এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে যে, দেশের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনাস্থায় রেখে, অবিশ্বাসের মধ্যে রেখে কিংবা তাদের নিষ্ক্রিয় রেখে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। 'পুলিশ জনগণের বন্ধু'—যে কথাটি বাংলাদেশে কেতাবি কথায় পরিণত হয়েছিল, সেটিকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। পুলিশকেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা সত্যিই জনগণের বন্ধু। এত বড় একটি ঘটনার পরেও তারা যদি এই পরিবর্তনের সূচনাটা করতে না পারে, তাহলে সেটি শুধু বাহিনী হিসেবে তাদের জন্যই নয়, বরং ‍পুরো দেশের জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments