ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: যুদ্ধ, শক্তিপরীক্ষা নাকি স্বার্থরক্ষা

ইসরায়েলে ১৮০টির মতো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। ছবি: রয়টার্স

ইরান হামলা করেছে খোদ ইসরায়েলের ভূখণ্ডেই। একের পর এক মিসাইল হামলা হয়েছে ইরানের তরফে। যদিও এসব মিসাইল হামলা প্রতিহত করেছে ইসরায়েল তার ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী স্থাপনা দিয়ে। কিন্তু এই হামলা গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তৈরি করেছে এক যুদ্ধাবস্থা। তৈরি হয়েছে উত্তেজনা ও আতঙ্ক।

গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা, লেবাননে ইসরায়েলি বর্বর আক্রমণের প্রত্যুত্তর হিসেবে এই হামলা পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যায়, সেটা অজানা। কেননা ইরানি হামলার পরপরই মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরান এই হামলা করে ঠিক কাজ করেনি। এর ফল ভুগতে হবে তাদের। এই হামলার নিন্দা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, ইসরায়েলকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়া হবে। আমেরিকা সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবে ইসরায়েলকে।

অন্যদিকে নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারির পর ইরানের বক্তব্য হচ্ছে, ইসরায়েল ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ নিলে পাল্টা হামলা চালানো হবে। উল্লেখ্য, গত ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণে হিজবুল্লার সদর দপ্তরে ইসরায়েলি বিমানহামলায় নিহত হন ইরানের সমর্থনপুষ্ট শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লার প্রধান হাসান নসরুল্লা।

এখন এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, অর্থনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করবে। চলমান মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে। প্রভাব পড়বে জ্বালানি তেলের মূল্যের ওপরও। সবচাইতে বড় কথা এই উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের রূপ লাভ করে কি না, সেই আশঙ্কাও থাকছে। এই পরিস্থিতি বিশ্বরাজনীতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে কি না, সেই শঙ্কাও থাকছে।

এই অবস্থা কেন হলো? আদৌ কি এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে? নাকি গুরুতর সংকটের দিকেই হাঁটছে বিশ্ব?

বিপদের আওয়াজ

ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারির ভাষায় ইসরায়েল ইরানের আক্রমণের বিরুদ্ধে সময়মতো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত এবং এটি সময়মতোই ঘটবে। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, এই হামলার জন্য ইরানের পরিণতি গুরুতর হবে। সেটা নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করবে। ইরান ইসরায়েলকে জানিয়েছে এই হামলার প্রতিশোধ নিলে তারও কড়া জবাব দেওয়া হবে। ইসরায়েলকে তাহলে আরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে পড়তে হবে।

অনেকের আশঙ্কা মধ্যপ্রাচ্য এখন পূর্ণ মাত্রার আঞ্চলিক যুদ্ধের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এর পরিবর্তন ঘটতে পারে তখনই যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলঘনিষ্ঠ আমেরিকান নীতির পরিবর্তন ঘটবে। ইসরাইলঘনিষ্ঠ আমেরিকান নীতির পরিবর্তন ছাড়া এই সংঘাত শেষ হবে না। ইসরায়েলে আমেরিকা অস্ত্র না পাঠালে, ইসরায়েলি অপরাধে তহবিল ও সহায়তা না করলেই এই সংঘাতের অবসান ঘটতে পারে।

অনেকের আশঙ্কা ইসরাইল এই হামলার প্রতিশোধ নেবেই। ইরানও বসে থাকবে না। হামলা-পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এক বৃহত্তর যুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।

ইসরাইল গত কয়েক মাস ধরে তার নারকীয় সামরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক শক্তিমত্তা ব্যাপক ধ্বংস করতে সক্ষম, সেটার প্রমাণ তারা লেবাননে দেখিয়েছে। তাদের বিশাল গোয়েন্দা কৃতিত্বও তারা প্রমাণ করেছে। ব্যাপক ধংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি যে তারা ঘটাতে পারে সেটা লেবানন ও ইরানের অভ্যন্তরে হামলা করে তারা দেখিয়েছে। ইসরায়েলি পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়তে হতে পারে ইরানকে, সেই আশঙ্কার কথাও শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে।

কেন এই হামলা

ইরান ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলে যেসব মিসাইল মেরেছে ইরান, তার বেশিরভাগই আমেরিকার সেনাদের সহায়তায় ইসরায়েলের অ্যান্টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা প্রতিহত করেছে। ফলে এই হামলার রাজনৈতিক গুরুত্ব যতটা বেশি, ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় ততটা কার্যকর নয়। ইরান হামলা করেছে ইসরায়েলে এটা শুনতে যত বিপদজনক মনে হয়, বাস্তবে এর ধ্বংসের কার্যকারিতা তেমন একটা নেই বললেই চলে। তবে কেন ইরান এরকম পদক্ষেপ নিল। সম্ভাব্য কারণগুলো এরকম—

১। ইরান পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটা প্রক্সি ওয়ার বা ছায়া যুদ্ধ জারি রেখেছে। গাজায় হামাস ও আল জিহাদ, লেবাননে হিজবুল্লাহ, সিরিয়ায় সিরিয়ান আর্মি, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীরা ইরানের সামরিক, আর্থিক, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জানপ্রাণ দেওয়া লড়াইয়ে অংশ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল এসব সংগঠনের ওপরে হামলা চালিয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষত হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া এবং হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নসরুল্লাহকে হত্যা করেছে। শুধু দুই নেতাকেই হত্যা করেনি, বরং লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ ও ধংসযজ্ঞ চালিয়েছে। গাজায় চালিয়েছে গণহত্যা। ফলে, পৃষ্ঠপোষক ইরানের প্রতি এসব সংগঠনের আস্থা, বিশ্বাস ও মনোবল বাড়াতেই ইসরায়েলে আক্রমণ করা ছাড়া ইরানের আর কোনো গত্যন্তর ছিল না।

২। ইসরায়েলের আগ্রাসী ভঙ্গি ঠেকাতেও ইরানকে এই হামলা করে তার শক্তিমত্তা জানান দিতে হয়েছে। ইরান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, প্রয়োজনে সেটা যে সে তার অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যবহার করতে পারে সেটা দেখাতেও ইরান এই হামলা চালিয়ে থাকতে পারে।

৩। এই হামলার সঙ্গে অনেকেই আমেরিকান নির্বাচনের সঙ্গত দেখতে পান। ইসরায়েল গাজায় যে গণহত্যা চালিয়েছে, সেটা আমেরিকান ডেমোক্রেট দলের অনেক সমর্থকের পছন্দ নয়। ইসরায়েলের এই গণহত্যা সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের একটা ভূমিকা তারা দেখতে চায়। অন্যদিকে মার্কিন ভোটারদের বড় অংশ ইসরায়েলকে সুরক্ষার পক্ষে। আমেরিকান ইহুদি লবি মার্কিন নির্বাচনে একটা বিশেষ ফ্যাক্টরও বটে। ফলে, আমেরিকান জনগণের মনে আস্থা ফেরাতে এই হামলার পেছনে মার্কিন প্রশাসনের একটা যোগসাজশ আছে বলেও অনেকে মনে করেন। ইরানের হামলাকে পুঁজি করে ইসরাইলকে অধিকতর সুরক্ষা দেওয়ার প্রশ্নে আমেরিকার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল—সেটা প্রমাণ করে ইসরায়েলমনস্ক আমেরিকান ভোটারদের কাছে পাওয়ার সুযোগ মিলল। আবার গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার কারণে যেসব আমেরিকান ভোটার ইসরায়েলকে ঢালাও সাহায্য করার প্রশ্নে একটু বিরূপ ছিল, নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে ইসরায়েলকে রক্ষার যুক্তিতে তাদেরও কাছে টানা গেল।

ফলে, ইরান কর্তৃক ইসরায়েলে মিসাইল হামলা আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনকে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ এনে দিলো, যা আখেরে আসন্ন নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী কমলা হ্যারিসের বিজয়কেই তরান্বিত করতে পারে। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অনুসারে এটা মূলত পেন্টাগন ও ইরানের রেভ্যুলেশনারি আর্মির পাতানো খেলা।

৪। ইরানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুব সুবিধের নয়। বিপ্লবোত্তর ইরানে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর তরুণ অংশ যারা মোট জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ, সেই নতুন জনগোষ্ঠী ইরানের ইসলামি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান চায়। পশ্চিমা চাপে ইরানের অর্থনীতির অবস্থাও সুখকর নয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভেদের ঝুঁকি কমানোর সবচেয়ে বড় ইস্যু হচ্ছে ইরানের নিরাপত্তার বিপদ দেখিয়ে দেশব্যাপী জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগুরক করা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টার জাগরণও সেই চেতনাকে সহায়তা করে। ফলে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটা যুদ্ধাবস্থা অথবা যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি খুব জরুরি ছিল বলে অনেকের ধারণা। ইসরায়েলে ইরানের এই হামলা সে কারণেও ঘটতে পারে।

৫। যারা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বাধিয়ে কিংবা যুদ্ধের আশঙ্কা জাগিয়ে সমরাস্ত্র বাণিজ্যকে চাঙা রাখতে চায়, তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের এই অবস্থা খুবই লাভজনক। একদিকে বিবদমান রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার প্রশ্নে সামরিক ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ, অন্যদিকে নানাভাবে লড়াইরত গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, চীনসহ সমরাস্ত্র বাণিজ্যের সিন্ডিকেট নিজের নিজের মতো লাভবান হতে পারে। এটাও এই অবস্থার কারণ হতে পারে।

৬। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্রমশ রূপান্তর ঘটছে। আমেরিকার উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করতে রাশিয়া, চীন নানাভাবে মুখিয়ে আছে। ইরানের সঙ্গে তাদের নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। সিরিয়া তার বড় উদাহরণ। ফলে, ইসরায়েলে হামলা করে ইরান সেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচকে নিজেদের অনুকূলে আনার ইঙ্গিত দিলো। সেটাও এই হামলার বড় কারণ।

যা ঘটতে পারে

প্রথমত, এই যুদ্ধের আশঙ্কা বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেবে, যা বিপাকে ফেলবে বিশ্ব অর্থনীতিকে। এর প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। মধ্যপ্রাচ্য-নির্ভর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, এই হামলা-পাল্টা হামলার উত্তেজনা আরও বাড়বে। যুদ্ধের পরিস্থিতি না ঘটলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা কমবে না। আমেরিকার নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে এই উত্তেজনা অস্ত্রের ভাষা ছেড়ে কূটনীতির ভাষায় রূপান্তরিত হতে পারে।

তৃতীয়ত, এই হামলা ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইরত সব পক্ষকে নিজেদের বিভেদ ভুলে আরও সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।

চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও চীন প্রকাশ্য ভূমিকা নিতে পারে, যা একদিকে তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে পুষ্ট করবে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার উদ্যোগে যে ইসরায়েলবান্ধব রূপান্তর ঘটছিল তাতে পরিবর্তন আনবে।

পঞ্চমত, ইরান যেহেতু ইসরায়েলে হামলার সাহস দেখিয়েছে, সেহেতু হামলা-পাল্টা হামলার সাজসাজ রব ছড়িয়ে পড়লেও ইসরায়েল আপাতত বড় কোনো যুদ্ধ চাইবে না।

ফলে, যুদ্ধের আশঙ্কা থাকলেও ইরান-ইসরায়েল তো বটেই, বিশ্বরাজনীতির মোড়লরাও যুদ্ধ এড়িয়ে শক্তিপরীক্ষা ও নিজ নিজ স্বার্থরক্ষাতেই এই উত্তেজনাকে ব্যবহার করবে।

শুভ কিবরিয়া: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

3h ago