সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা আসলে কাদের জন্য এবং কেন

জাতীয় শহীদ সেনা দিবস তথা পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবসে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের একটি বক্তব্য নিয়ে কয়েক দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা আলোচনা হচ্ছে। তার বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণের চেষ্টা চলছে যে তিনি আসলে কী বলতে চাইলেন এবং কী বার্তা দিলেন?
'নিজেদের মধ্যে হানাহানি বন্ধ না করলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে' বলে তিনি আসলে কাদেরকে সতর্ক করলেন এবং নিজেদের বলতে কাদেরকে বোঝালেন? শুধু তার বাহিনীর লোকদের নাকি অন্যান্য বাহিনী, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও গোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষকেও সতর্ক করলেন?
কেন তিনি ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর হত্যার ঘটনাটি তৎকালীন বিডিআর সদস্যরাই ঘটিয়েছেন বলে জোর গলায় উচ্চারণ করে এই বিষয়ে আর কোনো কথা হবে না বা 'এখানেই ফুলস্টপ' দিতে বললেন? কেন তাহলে এই ঘটনায় তদন্ত কমিশন গঠিত হলো—সেই প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা না বলে কেন শুধু 'ড. ইউনূস' বলে সম্বোধন করলেন—তা নিয়েও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সেনাপ্রধানের ওই বক্তব্যটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে দেশের বাইরে থাকা সামরিক বাহিনীর কোনো কোনো সাবেক কর্মকর্তা এবং কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারও যখন নানাবিধ প্রশ্ন তুলছেন, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'সেনাপ্রধান আমার জন্য অনেক উঁচু স্তরের লোক। তিনি একটি বাহিনী চালাচ্ছেন। তিনি কোনো কথা না বুঝে বলেননি। এর ইন্টারপ্রিটেশন (ব্যাখ্যা) কী, আপনারা জানেন।' (প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
একটু পেছনে ফেরা যাক। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার দিন সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান মানুষকে সংঘাতের পথ এড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি সমস্ত হত্যা, সমস্ত অন্যায়ের বিচার আমরা করব। আপনারা সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন। আমি সমস্ত দায়দায়িত্ব নিয়েছি। আপনাদের জানমাল এবং আপনাদেরকে কথা দিচ্ছি যে আপনারা আশাহত হবেন না।' (ডয়েচে ভেলে, ০৫ আগস্ট ২০২৪)
সেনাপ্রধানের এই দায়িত্ব গ্রহণ এবং এরপরে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনীর মাঠে থাকার পরেও দেশে যখন একের পর এক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে; ডাকাতি-খুন-ধর্ষণ-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বাড়ছে; পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও থামছে না; অপরাধ দমনে অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে একটি বিশেষ অভিযান শুরু করতে হয়েছে এবং সরকারের আইন উপদেষ্টাও বলছেন যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই; যখন ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি অব্যাহত রয়েছে; যখন নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সরকার ও তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে—সেরকম বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাড়ে ছয় মাস পরে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবসের এক অনুষ্ঠানে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় দেশবাসীকে সতর্ক করে সেনাপ্রধান বলেন, 'আপনারা যদি হানাহানি বন্ধ না করেন, তাহলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।'
সেনাপ্রধান যেদিন এই বক্তব্য দিলেন তার ঠিক আগের দিন তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্টে এক অনুষ্ঠানে সেনা সদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, 'যতদিন না একটা নির্বাচিত সরকার পাই, ততদিন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী কাজ করে যাবে।' কাজ করতে গিয়ে বলপ্রয়োগ করা যাবে না উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, 'মাঝে মাঝে কাজ করতে গিয়ে কিছু বলপ্রয়োগ হয়ে যায়। বলপ্রয়োগ করতে গেলেও অত্যন্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে যেন হয় এবং যত কম বলপ্রয়োগ করা যায় ততই ভালো।'
এর পরদিন সেনাপ্রধানের পুরো বক্তব্যটি যারা দেখেছেন এবং শুনেছেন, তারা তার প্রতিটি বাক্য, শব্দ এবং তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তথা শরীরী ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ও অভিব্যক্তি যদি খেয়াল করে থাকেন তাহলে দেখবেন যে, তিনি বেশ ক্ষুব্ধ। গত প্রায় সাত মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যা যা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি যে খুব সন্তুষ্ট নন এবং অনেক বিষয় নিয়ে তিনি যে বিরক্ত, সেটি তার অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট।
মানুষ যখন কথা বলে তখন দুটি বাক্যের মাঝখানের বিরতি, বিশেষ শব্দের ওপর জোর, কোনো একটি কথা বলতে গিয়ে অভিব্যক্তির পরিবর্তন ইত্যাদি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে কী কী শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করলেন এবং কোন কথাটি বলার সময় তার শরীরী ভাষায় কেমন ছিল, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নাম উচ্চারণ করলেন তখন তাকে কী বলে সম্বোধন করলেন—সেটিও মানুষের দৃষ্টি এড়ায়নি।
তিনি মূলত কথা বলছিলেন বিডিআর বিদ্রোহের বিষয় নিয়ে। সেই প্রসঙ্গ শেষ হওয়ার পরেই তিনি উপস্থিত লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, তিনি এখন এমন কিছু কথা বলতে চান যা অনেকের হয়তো ভালো লাগবে না। তিনি এও বলেন যে, আমি আপনাদের সতর্ক করছি এবং 'সতর্ক' শব্দটি তিনি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। মনে রাখতে হবে, খুব স্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতিতে একজন সেনাপ্রধান কখনো এভাবে সতর্ক করেন না।
তার বক্তব্যের কয়েকটি পয়েন্ট এরকম:
১. যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের। আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই। আই হ্যাড এনাফ লাস্ট সেভেন এইট মান্থস। আই হ্যাড এনাফ। আমি চাই দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।
২. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের কারণ আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত। পুলিশ সদস্য কাজ করছে না তার বড় কারণ হচ্ছে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে জেলে। র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই প্যানিকড। বিভিন্ন দোষারোপ, গুম, খুন ইত্যাদির তদন্ত চলছে। অবশ্যই তদন্ত হবে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এমনভাবে কাজটা করতে হবে যেন এই অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন্ড না হয়।
৩. পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে অতীতে। খারাপ কাজের সঙ্গে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। আজকে যে দেশের স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে এটার কারণ হচ্ছে এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সেনা সদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে অসামরিক-সামরিক সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে এফেক্টিভ রেখেছে।
নিজেরা মানে কারা?
সেনাপ্রধান বলছেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। এখানে তিনি নিজেরা বলতে কাদেরকে বুঝিয়েছেন? যেহেতু ওই অনুষ্ঠানটি ছিল বিডিআর বিদ্রোহ তথা পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস উপলক্ষে এবং সেখানে মূলত সামরিক বাহিনীর বর্তমান কর্মকর্তা ও সদস্য এবং সাবেক কর্মকর্তা, বিশেষ করে পিলখানায় শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন, ফলে তিনি হয়তো তার বাহিনীর লোকদেরকেই সতর্ক করেছেন। কিন্তু তিনি যেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বাহিনী বা কারো নাম উল্লেখ করেননি, ফলে তার ওই সতর্কবার্তাটি সকলের জন্য—এভাবে ব্যাখ্যা করারও অবকাশ রয়েছে।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থেকেই মানুষের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে। ফেসবুকের প্রোফাইল লাল না কালো—সেই ইস্যুতেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক মত ও আদর্শে মানুষকে কতটা বিভক্ত এবং সেই বিভক্তি কীভাবে ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্ম দিতে পারে, তাও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। পরমতসহিষ্ণুতা তথা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাই যে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। প্রতিশোধপরায়ণতা ভীষণরকম বেড়েছে। বিগত বছরগুলোয় যারা রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিত ও বঞ্চিত হয়েছে, তারা এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। অতীতে একটি পক্ষ যেমন প্রতিপক্ষকে চিরতরে নির্মূল করতে চেয়েছে, ৫ আগস্টের পরে সেই শক্তিকেই নির্মূলের চেষ্টা চলছে। অর্থাৎ ক্ষমতায় গেলে সবাই যে তার প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে এককভাবে টিকে থাকতে চায়, এই প্রবণতাটি বেড়েছে—যা দেশকে স্থিতিশীল করার বিপরীতে আরও বেশি সংঘাতপূর্ণ করে তুলছে।
শুধু ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিষোদগার নয়, বরং সেনাবাহিনীকে নিয়েও অনেকে বিষোদগার করছেন—যা অতীতে কখনো বাংলাদেশে হয়নি। সেনাপ্রধান এই বিষয়টিও উত্থাপন করেছেন এবং সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিষোদগার না করার অনুরোধ করেছেন।
একসময় যে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল, এখন তাদের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে দূরত্ব স্পষ্ট হচ্ছে। এই বিভক্তি সামনের দিনগুলোয় বড় ধরনের সংঘাতে জন্ম দেবে কি না—তা এখনই বলা মুশকিল। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্যেও বিভক্তি স্পষ্ট। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজিসহ নানা ঘটনায় তারা সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে।
সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান যে দৃঢ়ভাবে কথা বললেন এবং সতর্ক করলেন, সেই সতর্কবার্তাটি সম্ভবত শুধু তার নিজের বাহিনীর লোকদের জন্য নয়, বরং সবার জন্যই। তিনি বারবারই ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। যে ঐক্যের ঘাটতিই এখন দেশের প্রধান সমস্যা বলে মনে হয়।
বিডিআর হত্যা নিয়ে বার্তা কী?
বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাপ্রধান সুস্পষ্ট করে বলেছেন, 'আমি এই বর্বরতার চাক্ষুষ সাক্ষী। একটা জিনিস আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে এই বর্বরতা কোনো সেনা সদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিডিআর সদস্য দ্বারা সংগঠিত। ফুল স্টপ, এখানে কোনো ইফ এবং বাট নাই।'
যদিও এদিনই প্রধান উপদেষ্টা যে বাণী দিয়েছেন সেখানে তিনি বলেছেন, 'শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রিয়জন হারানোর এত বছর পরও স্বজন হত্যার বিচার পেতে অপেক্ষা করে আছেন। পিলখানায় বীর সেনাসদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অনেক বছর ধরে জাতি হিসেবে আমাদের নানা বিভ্রান্তিতে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই নির্মমতার সুবিচার নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। সমব্যথী হয়ে দেশ ও জনগণ শহীদ পরিবার ও সব নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াবে সেই আশাবাদ রাখছি একইসঙ্গে।'
নির্বাচন ডিসেম্বরেই?
সেনাপ্রধান সবশেষ জোর দিয়েছেন একটি অবাধ সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর। তিনি বলেছেন, 'আমরা দেশে ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ একটা ইলেকশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি এবং তার আগে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন অবশ্যই সরকার সেদিকে খেয়াল করবেন।'
তিনি বলেছেন ফ্রি (অবাধ), ফেয়ার (স্বচ্ছ) ও ইনক্লুসিভ (অংশগ্রহণমূলক) নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান স্টেকহোল্ডাররা শুরু থেকেই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও বিএনপি বলেছে তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। কেননা জনগণই ঠিক করবে কারা রাজনীতি করবে বা করবে না। সুতরাং আওয়ামী লীগকে যদি সরকার নির্বাচনের আগে নিষিদ্ধ করে বা ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশ বা পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তাদের নিবন্ধন বাতিল করে দিয়ে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করে, তাহলে সেই নির্বাচনটি কি অংশগ্রহণমূলক হবে? সেনাপ্রধান কি সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই সচেতনভাবেই ইনক্লুসিভ (অংশগ্রহণমূলক) শব্দটি ব্যবহার করেছেন নাকি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল যাতে সমান সুযোগ পায় এবং বিশেষ কোনো দল যাতে সরকারের সুনজরে না থাকে, সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন?
সেনাপ্রধান বলেছেন, 'আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, হি কমপ্লিটলি এগ্রিস উইথ মি। দেয়ার শুড বি ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইদিন ডিসেম্বর অর ক্লোজ টু দ্যাট।' অর্থাৎ আগামী জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে অথবা তার কাছাকাছি সময়ে হবে। স্মরণ করা যেতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরেই সেনাপ্রধান বলেছিলেন, দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে হিসাব করলে দেড় বছর হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি। মঙ্গলবারের বক্তৃতায়ও তিনি সেটি পুনরায় স্পষ্ট করলেন।
প্রসঙ্গত, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি বেশ শক্ত অবস্থানে থাকলেও সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর নির্বাচন নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। হয়তো তারা এটা জানে যে, অবাধ সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। সুতরাং তারা বিএনপিকে হয়তো স্পেস দিতে চায় না।
স্মরণ করা যেতে পারে, এই সরকার গঠনের পরে অনেকে এটাকে 'মাইনাস টু' বলেছিলেন। অর্থাৎ শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিও মাইনাস হবে। অন্য কোনো দল সরকার গঠন করবে। সুতরাং সেরকম পরিস্থিতি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সরকার নির্বাচন দিতে চায় না—এরকম গুঞ্জনও আছে। সেই বাস্তবতায় সেনাপ্রধানের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বক্তব্যটি বেশ দৃঢ়। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন ইস্যুতে সরকার এবং তার ঘনিষ্ঠ দল ও সংগঠনগুলো যদি ঐকমত্যে না পৌঁছায় তখন কী হবে? সেনাপ্রধান কি তাহলে এই অনৈক্যের সৃষ্টি হলে দেশে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং তার ধারাবাহিকতায় এমন কিছু ঘটবে, যার ফলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে বলে সবাইকে সতর্ক করলেন?
বক্তব্যের সমালোচনা কেন?
নিজেদের মধ্যে হানাহানি বন্ধ না হলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে বলে সেনাপ্রধান সতর্ক করলেও তার ওই বক্তব্যের কিছু সমালোচনাও হচ্ছে। যেমন:
১. গত বছরের ৫ আগস্ট 'আমি সমস্ত দায়দায়িত্ব নিয়েছি' বলা এবং তারপরে গত কয়েক মাস ধরে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মাঠে থাকার পরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি; ডাকাতি-ছিনতাই এবং তার বিপরীতে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, সেনাপ্রধান তার দায় এড়াতে পারেন কি না?
২. গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনদিন কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিল না। সেই সুযোগে আওয়ামী লীগ তথা সাবেক সরকারের প্রভাবশালীরা ব্যক্তিরা যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, সেই দায়ও সেনাপ্রধান এড়াতে পারেন কি না—এমন প্রশ্নও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে তুলেছেন।
৩. প্রধান উপদেষ্টা যেখানে বললেন পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অনেক বছর ধরে জাতি হিসেবে আমাদের নানা বিভ্রান্তিতে রাখা হয়েছে, সেনাপ্রধান সেখানে বললেন, যারা শাস্তি পেয়েছেন, তারা এটার যোগ্য। তার মানে এখানে বিডিআর হত্যার বিচার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট।
এদিনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজশ করে পিলখানায় দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে।' মির্জা ফখরুল প্রশ্ন করেন, সেদিন যিনি রাষ্ট্রের দায়িত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা, তিনি কী ভূমিকা পালন করেছিলেন? সহকর্মীদের রক্ষায় সেনাপ্রধান কী ভূমিকা পালন করেছিলেন?
তার মানে, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যেও পার্থক্য আছে। প্রশ্ন হলো, বিডিআর হত্যার বিচার নিয়ে সেনাপ্রধান যা বললেন তার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের ভিন্নতা কি বিশেষ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments