তরুণরা কেন এত সহিংস হয়ে উঠছে?

স্টার ফাইল ছবি

প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে তুচ্ছ কারণে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাটি আমাদের সমাজের একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে। আর সেটি হলো, বিরোধ নিষ্পত্তির একমাত্র উপায় সহিংসতা।

তারচেয়েও ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, তরুণদের মাঝে সহিংসতা ও নৃশংসতার প্রতি এক ধরনের মোহ তৈরি হয়েছে।

পারভেজ হত্যাকাণ্ডে সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত প্রধান তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারাসহ এই মামলার আসামিদের সবারই বয়স ২০-এর ঘরে।

বন্ধুদের নিয়ে পারভেজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশে একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন ও নাস্তা করছিলেন, তখন এই ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সময় আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তারা ধরে নেন যে, পারভেজ ও তার বন্ধুরা তাদের নিয়েই হাসাহাসি করছিলেন। এরপর ওই দুই তরুণী তাদের বন্ধুদের বিষয়টি জানায় এবং কিছুক্ষণ পরই একদল তরুণ—সম্ভবত তারাও শিক্ষার্থী—এসে পারভেজকে জেরা করতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক এসে ঘটনার মিটমাটও করে দেন।

কিন্তু তাতে ক্ষোভ মেটেনি ওই তরুণদের। পরবর্তীতে পারভেজ ও তার বন্ধুরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন ওই তরুণরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পারভেজ ও তার বন্ধু তারিকুলের ওপর হামলা করেন। পারভেজের বুকে ছুরিকাঘাত করা হয় এবং তিনি মারা যান। তার বন্ধুও গুরুতর আহত হয়েছেন।

এভাবেই দুজন তরুণীকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল সন্দেহে একটি তরুণের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। পারভেজের ওপর হামলাকারীরা এতটাই রক্তপিপাসু ছিল যে, প্রকাশ্যে একজন মানুষকে হত্যা করেছে। এর জন্য কতটা মূল্য চুকাতে হতে পারে, সেটাও তাদের বিবেচনায় ছিল না। কীভাবে এই তরুণরা এত তুচ্ছ কারণে একজন মানুষ হত্যা করার মতো নিষ্ঠুর ও নির্দয় হয়ে উঠতে পারে?

আমাদের সমাজের জন্য একটি ভয়াবহ সংকেত হচ্ছে, গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংস হামলা এবং এসব হামলায় মৃত্যু। এসব দেখে মনে হচ্ছে, আমরা হয়তো নৈতিক দিকনির্দেশনাই হারিয়ে ফেলেছি এবং সমাজে সহানুভূতি, সম্মান ও মমতার ভয়াবহ অভাব তৈরি হয়েছে, যা তরুণদের মননে ছড়িয়ে পড়েছে।

কলেজ শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষ এবং এসব সংঘর্ষের ফলে তাদের পাশাপাশি পথচারীদের আহত হওয়ার খবর এখন প্রায় নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রমাণ করে যে, এই তরুণরা সহিংসতার প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করছে। সম্প্রতি কুমিল্লা শহরের রাস্তায় প্রায় শতাধিক তরুণ উচ্ছৃঙ্খল মিছিল করেছে। তাদের অনেকের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র এবং মোটরসাইকেলে বিকট শব্দ তুলে সেই মিছিল এগিয়ে যায়। হঠাৎ এমন মিছিলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন শহরের বাসিন্দা ও মিছিল যে পথ ধরে গেছে সেখানকার বাসিন্দা ও পথচারীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ফুটেজগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, সহিংস অপরাধ যারা করছে, তাদের অধিকাংশই কিশোর কিংবা ২০ ঘরের তরুণ।

আমাদের তরুণদের কী হচ্ছে? সত্যি বলতে, তারা যে পরিবেশে বেড়ে উঠছে সেটা বিবেচনায় নিলে, এই তরুণদের অনেকের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়াটা আর বিস্ময়কর লাগবে না।

তরুণদের মধ্যে এই সহিংসতার তৃষ্ণা তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে রাজনীতি। তারা দেখছে, রাজনৈতিক দলের বড় ভাইরা কীভাবে নৃশংসতার মাধ্যমে অন্যদের মাঝে ভয় তৈরি করে 'সম্মান' আদায় করে নেয়। সেটা দেখে বাড়ন্ত এই কিশোর ও তরুণরাও মনে করে, তাদের ক্ষমতার মাপকাঠি নির্ধারণ হবে সহিংসতা দিয়েই।

বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সহিংসতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় এককভাবে ক্ষমতায় থাকায় ছাত্রলীগ একচেটিয়া সহিংসতা চালিয়ে গেছে এবং এর জন্য তাদের কোনো ধরনের জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়নি। ২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের সদস্যরা। অথচ, তারা ছিল আবরারেরই সহপাঠী এবং দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটের শিক্ষার্থী।

গত বছর প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে প্রায় ২৩৭টি 'কিশোর গ্যাং' ছিল, যার অধিকাংশই ঢাকায়। এখানে 'কিশোর' শব্দটি মূল ২০-এর কোঠায় পা দেওয়া তরুণদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। এসব গ্যাংয়ে হাজারের বেশি তরুণ সদস্য আছে। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক চোরাকারবার, জমি দখল, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও খুনসহ নানা অপরাধে জড়িত। মাঝে মাঝে এক গ্যাংয়ের সঙ্গে আরেক গ্যাংয়ের সংঘর্ষে গুরুতর আহত বা নিহতের ঘটনাও ঘটে।

এই তরুণ অপরাধীদের নিয়মিত গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করার পরও সামাজিক ব্যাধিটি ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ, তারা শিক্ষার্থীদের ভেতরে সহানুভূতিশীল মানসিকতা গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিবারে আর্থিক সংকট, সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের যোগাযোগের ঘাটতি এবং অভিভাবক বা পরিচিত কারো দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতা—এসব কারণও তরুণদের সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ঘটনায় নারীকেই যখন দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং অপরাধী পুরুষ পার পেয়ে যায়, তখন এই তরুণদের একটি বড় অংশ এ ধরনের অপরাধে উৎসাহিত হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ ১৫-২৯ বছর বয়সী। এত সংখ্যক তরুণ জনসংখ্যা থাকার উপযোগিতা নিয়ে প্রচুর কথা বললেও এই বাস্তবতাকে আমরা উপেক্ষা করি যে, তাদের অনেকেই পরিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদান থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে রয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাদ্য ও সম্মানজনক চাকরি। অনেকেই সঠিক দিকনির্দেশনা ও ভালোবাসা পায় না—যা একটি শিশুর মানসিক বিকাশে অত্যাবশ্যক। স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে তারা অনুপ্রেরণা পায় না; প্রতিটি ক্লাসে অনেক বেশি শিক্ষার্থী থাকায় তাদের প্রতি ব্যক্তিগত মনোযোগ দিতে পারেন না শিক্ষকরা; তরুণদের খেলাধুলা বা বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় তাদের বিনোদন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেটে, যেখান থেকে তারা সহিংস কনটেন্ট আর পর্নোগ্রাফির সংস্পর্শে যাচ্ছে।

বাস্তবতা হলো, আমাদের সরকার ও সমাজ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তারুণ্যকে দীর্ঘদিন ধরে চরম অবহেলা করেছে। তরুণদের কেবল দেখা হয়েছে সস্তা শ্রমিক হিসেবে, যারা অর্থনীতির চাকা ঘোরাবে এবং প্রচুর রেমিট্যান্স আনবে। কিন্তু তাদের উন্নয়নে নীতিগত বা বাস্তবিক কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেখিয়েছে, তরুণরা এক হলে কতটা শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারে, কীভাবে তারা স্বৈরাচার উৎখাতে নেতৃত্ব দিতে পারে। তাদের সাহস ও ত্যাগ বাকি সবাইকে ন্যায়বিচারের এই আন্দোলনে সামিল হতে অনুপ্রাণিত করেছে। সময় এসেছে এই শক্তি ও উদ্যমকে কাজে লাগানোর।

অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই তরুণদের অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও আয়ের সুযোগের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের পরিকল্পনা নিতে হবে। সেইসঙ্গে তাদের মাঝে এই অনুভূতি প্রবল করতে হবে যে, তারাই জাতির পুনর্নির্মাণের অংশ।

সবচেয়ে বড় কথা, তরুণদের সহানুভূতিশীল ও শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পুরো সমাজকে সচেষ্ট হতে হবে। এটাই জাতিকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র পথ।


আশা মেহরীন আমিন, জয়েন্ট এডিটর, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Sabalenka beats Anisimova to win second straight US Open title

The Belarusian has not missed a hardcourt major final since 2022 and her latest trophy brings her Grand Slam haul to four, as she became the first woman to win back-to-back US Opens since Serena Williams claimed three straight from 2012 to 2014

3h ago