‘মব’ যদি ‘জনরোষ’ হয়, তাহলে থামাবে কে?

জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে বিএনপির করা মামলার আসামি হওয়ার ছয় ঘণ্টা পরই ২২ জুন রোববার সন্ধ্যায় কথিত ছাত্র-জনতা রাজধানীর উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার বাসায় চড়াও হয়। তারা সাবেক এই সিইসির শরীরে ডিম ছুঁড়ে মারে, বাসা থেকে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায় নীচে নামিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। পরে সেই জুতা দিয়ে তাকে মারধরও করা হয়।
যত বিতর্কই থাকুক, একটি সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তি—যার বড় পরিচয় বীর মুক্তিযোদ্ধা—তাকে এভাবে হেনস্থা করা হলো খোদ পুলিশের সামনেই। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারো সঙ্গে এরকম ব্যবহার করা যাবে না।
তার মানে প্রচলিত বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কোনো ব্যক্তি, দল, সংগঠন তো বটেই, রাষ্ট্রও কাউকে কোনো ধরনের লাঞ্ছনাকর শাস্তি দিতে পারবে না। অতএব, সাবেক সিইসির সঙ্গে যা হয়েছে, সেটি দেশের ফৌজদারি আইনে যেমন একটি অপরাধ, তেমনি এটি স্পষ্টত সংবিধানেরও অমাননা।
দেশে এরকম ঘটনা যে এই প্রথম ঘটলো, তা নয়। বিগত সরকারের আমলেও এরকম অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কেবল তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও সরকারবিরোধী মনোভাব পোষণ করার কারণে এরকম 'শাস্তি' দেওয়া হয়েছে। সেসব ঘটনায় কারো শাস্তি হয়েছে কিন্তু বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের গত সাড়ে ১০ মাস ধরে মব তৈরি করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ভবন, ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা, আগুন দেওয়া, বিগত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে হেনস্থা করা, বাড়িঘর এমনকি অফিস দখল করার মতো ঘটনাগুলো অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মব তৈরি করা হয়েছে, হেনস্থা করা হয়েছে।
গত ২৬ মে সেনা সদরের প্রেস ব্রিফিংয়ে যেদিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হলো, 'কেউ মব তৈরি করে বিশৃঙ্খলা করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সেনাবাহিনী'—সেদিনই গণমাধ্যমের খবর: হেফাজতে ইসলামের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামের পর নরসিংদী সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক নাদিরা ইয়াসমিনকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে।
তাহলে যারা মব তৈরি করে, তারা সেনাবাহিনীর হুঁশিয়ারিকেও পাত্তা দেয় না?
গত জানুয়ারি মাসে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেয় স্থানীয় কিছু মানুষ। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ৩০ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়া হয় এবং স্থানীয় প্রশাসনকে খেলা আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, কেউ যদি নারীদের অধিকার লঙ্ঘন বা বেআইনি বিধিনিষেধ আরোপের সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাগরিকদের প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়নের যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই হুঁশিয়ারির এক সপ্তাহ না যেতেই রংপুরের তারাগঞ্জে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হয় 'তৌহিদী জনতা' নামে কিছু লোকের প্রতিবাদের মুখে। এমনকি সেখানে ১৪৪ ধারাও জারি করে প্রশাসন। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার হুঁশিয়ারির মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে কী করে এই ঘটনা ঘটলো? যারা মব তৈরি করে একটি খেলা বন্ধ করে দিতে পারে, তারা কি সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী? স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন কেন খেলা বন্ধ করে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করলো? এর মধ্য দিয়ে কার দুর্বলতা প্রকাশ পেলো?
সবশেষ সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে জুতাপেটা করা হলো পুলিশের উপস্থিতিতেই। পুলিশ কেন এটা প্রতিহত করলো না বা করতে পারলো না? যদিও গণমাধ্যমের খবর বলছে, এই ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে সেনাবাহিনী। তার নাম হানিফ। বাস্তবতা হলো, এই ব্যক্তি খুব দ্রুতই হয়তো জামিনে বেরিয়ে যাবেন। গণমাধ্যমে নতুন ইস্যু চলে আসবে, অতএব এই বিষয়টির আর ফলোআপ করা হবে না।
প্রশ্ন হলো, এই ঘটনার যদি ভিডিও ফুটেজ না থাকতো এবং যদি এটা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা না হতো, তাহলে কি তাকে আটক করা হতো বা সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে এই ধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া হতো?
সবগুলো ঘটনার ভিডিও বা ছবি থাকে না। প্রতিনিয়তই দেশের কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটছে। তার কয়টি ঘটনার ভিডিও বা ছবি থাকে? আবার যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে কতগুলো ঘটনায় জড়িতদের আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে? গ্রেপ্তারের পরে তাদের পরিণতি কী হয়েছে—এসব প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
২.
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে যেদিন হেনস্থা করে পুলিশে দেওয়া হলো, সেদিনই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট মামলায় রাজধানীর উত্তরা থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় মব কর্তৃক সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও অভিযুক্তকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। সরকার দেশের সকল নাগরিকের প্রতি আবারও আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। মব সৃষ্টি করে উশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী সকলকে চিহ্নিত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অথচ এর তিন দিন পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'আমি এটাকে মব বলছি না, বলছি প্রেশার গ্রুপ। সেটি তৈরি হওয়ার গ্রাউন্ড কেন তৈরি হচ্ছে! কেননা, সে তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ১৫ বছরে তো তার (প্রেশার গ্রুপ) মিনিমাম সিভিল লিবার্টি রাখা হয়নি।'
তবে প্রেস সচিব বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত মত, সরকারের নয়।
এর আগের দিন একটি টেলিভিশনের টকশোতে সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে মব তৈরি করে হেনস্থার প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, 'সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলেই জনরোষ তৈরি হয়েছে। সরকার যদি আগেই তাদের গ্রেপ্তার করত তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।'
তার মানে কি এই যে, একজন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মব তৈরি করতে পারবেন? তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে আরও দশজনের ক্ষতি করার অধিকার তার জন্মাবে? যদি তাই হয় তাহলে রাষ্ট্রে আইন-আদালত রাখার কী প্রয়োজন?
প্রসঙ্গত, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে দায়ের করা রিট যেদিন (২২ মে) খারিজ করে দিলেন হাইকোর্ট, ওইদিন দুপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, 'মব তৈরি করে যদি হাইকোর্টের রায় নেওয়া যায় তাহলে এই হাইকোর্টের দরকার কি?'
বিষয়টা কি এমন যে, এনসিপি বা তাদের সহযোগীরা যদি কোনো জনবিশৃঙ্খলা ঘটায় তাহলে সেটি হবে জনরোষ কিংবা প্রেসার, আর এর বাইরে অন্যরা যা করবে সেগুলো হবে মব? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যদি মবকে জনরোষ বা প্রেসার বলে অভিহিত করেন, সেই দেশে কোনোদিন মব বন্ধ হবে? কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ধরনের জনবিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড প্রতিহিত করার সাহস করবে?
৩.
অনেকেই মনে করেন বা প্রকাশ্যে না হলেও ব্যক্তিগত পরিসরে আলাপচারিতায় বলেন, এই সরকারের একটি বড় শক্তি 'মব'। কথাটি হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়। কিন্তু জনমনে যে পারসেপশনটা তৈরি হয়েছে, এটিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে যতগুলো বড় মবের ঘটনা ঘটেছে, সরকার চাইলে খুব সহজেই সেগুলো প্রতিহত করতে পারতো। বিশেষ করে সেনাবাহিনী যখন বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে রয়েছে।
কিন্তু এগুলো সরকার প্রতিহত করেনি। কেন করেনি? সরকার কি চেয়েছে যে ওই স্থাপনাগুলো ভাঙা হোক বা ওই ব্যক্তিগুলো আক্রমণের শিকার হোক? খোদ আদালত প্রাঙ্গণে অনেক আসামির ওপর হামলা হয়েছে। অনেক ঘটনায় খোদ আইনজীবীরা যুক্ত ছিলেন, এমন দৃশ্যও দেখা গেছে। অথচ একজন আসামির রাজনৈতিক পরিচয় বা তার অপরাধের মাত্রা যাই হোক না কেন, আদালত হচ্ছে নিরপেক্ষ জায়গা; সেখানে কারো ওপর হামলা চালানোর সুযোগ নেই। যদি বিচারের আগেই এই ধরনের হামলা হয়, সেটি স্পষ্টত আদালতের অসম্মান।
অনেকে এ ধরনের ঘটনার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে যে বয়ান দেওয়ার চেষ্টা করছেন সেটি হলো, অতীতেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। অতীতে ঘটেছে বলে এখনও ঘটতে হবে বলে যারা মনে করেন, ভবিষ্যতে তারাও এই ধরনের মবে শিকার হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং অতীতে যা হয়েছে, সেসব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবিক চিন্তা, দর্শন ও সহনশীল রাজনীতির চর্চা শুরুর করার এখনই সময়। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
অনেকেই যে প্রশ্নটি করছেন তা হলো, সরকার কি আসলেই মব প্রতিহত করতে চায়? নাকি তারাও মবকে ভয় পায়? কেন বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই তারা একটি বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চায়? এরকম অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে এই সরকারের পক্ষে আগামী ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে? নির্বাচনের দিনও যদি নানা জায়গায় মব হয় এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যদি এগুলো প্রতিহত না করে বা করতে না পারে, তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? সরকার যদি মবকারীদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী না হয়, তাহলে মবের জয় হবে। আমরা কি মব ও মবকারীদের জয় দেখতে চাই?
অব্যাহত মবের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, 'জনগণকে সচেতন করতে হবে। জনগণ এমন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেলে অনেক সময় কিন্তু সমস্যা হয়। বাহিনী দিয়ে তো সব সময় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।' প্রশ্ন হলো, বাহিনী দিয়ে যদি মব নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে জনগণের ট্যাক্সের পয়সা দিয়ে সেই বাহিনী রাখার কী দরকার?
দ্বিতীয়ত, কে কাকে সচেতন করবে? সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে কি পাল্টা মব তৈরি করবে? তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? জনগণকে সচেতন করেই যদি পৃথিবীতে মব বা অপরাধ থামানো যেত, তাহলে আর পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগের প্রয়োজন হতো না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ। শান্তিতে নোবেলজয়ী। অথচ তার আমলেই দেশে সবচেয়ে বেশি মবসন্ত্রাস হচ্ছে। এটি তার নিজের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করছে। কেননা যেকোনো ধরনের মব শান্তির প্রতিপক্ষ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনকালকে ভবিষ্যতে যদি 'মবের আমল' হিসেবে চিত্রিত করা হয়, সেটি তার মতো একজন মানুষের জন্য তো বটেই, সাম্য-মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ এবং এই দেশের জনগণের জন্যও অত্যন্ত বেদনার কারণ হবে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments