‘নির্বাচন’: বিএনপির দাবি কি টিকবে

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কবে হবে? বলা যায় এ নিয়ে 'টাগ অব ওয়ার' চলছে রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে। প্রধান উপদেষ্টা প্রথম থেকেই বলে আসছেন, নির্বাচন হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে। তার কথার নড়চড় হয়নি এখনো।

প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত বিএনপি ও তাদের সমমনাদের দূরত্ব বাড়ছে। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচন হবে ডিসেম্বরেই, এমনকি ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন সম্ভব।

অন্যদিকে জাপান সফররত প্রধান উপদেষ্টা সেখানে এক বক্তৃতায় বলেছেন, কিছু ব্যক্তি সংস্কার রেখে নির্বাচন শেষ করতে বলছেন এবং সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাইছে।

বিএনপির দাবি

২৯ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান বলেন, 'প্রস্তাবিত সংস্কার শেষ করে, যদি তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) ইনটেনশন সঠিক থাকে, গণতন্ত্রের পক্ষে থাকে, আমরা দাবি করেছি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে। তবে আমি এটাও মনে করি, বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে, সংস্কার প্রস্তাব শেষ করে…যেহেতু কমবেশি সকল বিষয়ে… অধিকাংশ দলগুলোর মধ্যে মত রয়েছে, একমত রয়েছে, ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন করা সম্ভব।' (প্রথম আলো অনলাইন, ২৯ মে ২০২৫)

২৮ মে নয়াপল্টনে এক জনাকীর্ণ সমাবেশে ভার্চুয়ালি তারেক রহমান বলেছেন—

১. 'আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। আবারও আমরা বলতে চাই, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।'

২. 'আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। কারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, কারা আপনাদের প্রতিনিধি হবে, জাতীয় নির্বাচনে আপনারা ভোট দিয়ে আপনাদের সেই প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন।'

৩. 'আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। এরই ভেতরে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।' (প্রথম আলো অনলাইন, ২৯ মে ২০২৫)

নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে মুখ্যত বিএনপি কিছুটা মরিয়া।

তারেক রহমানের ভাষায়, 'আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।' যেকোনো মূল্যে তারা ডিসেম্বর, এমনকি ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন চায়।

বিএনপির সক্রিয়তা ও জনমানুষের সম্পৃক্ততা

বিএনপি পরিষ্কার দাবি জানিয়েছে, তারা ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়। নির্বাচন কবে হবে সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলার কথা নির্বাচন কমিশনের। এখানে বিএনপির পক্ষ থেকে তারিখ নির্দিষ্ট না করে মাস নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে ডিসেম্বর ২০২৫ সালের কথা।

সত্যিই কি ডিসেম্বরে নির্বাচন হচ্ছে? বিএনপির ঘোষিত নির্বাচনী মাস সত্যি সত্যিই কি নির্বাচন কমিশনের ঘোষণার সঙ্গে মিলে যাবে?

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান সুদূর জাপানে গিয়ে বলেছেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন একটি বিশেষ দলের দাবি। ড. ইউনূস কি তাহলে ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করবেন না?

বিএনপি যদি ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি আদায় করতে না পারে, তাহলে তাদের রাজনৈতিক কৌশল কী হবে? জনগণকে নিয়ে মাঠে নামবে? কোন জনগণ নামবে?

প্রশ্ন হচ্ছে—

১. বিএনপি নির্বাচনের সময় ঘোষণার দাবিতে বড় বড় জনসভা করছে, সেখানে বিপুল জনসমাবেশ ঘটছে। সেখানে কারা অংশ নিচ্ছেন? দলের নেতাকর্মী। এখানে বিএনপির সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে, আর্থিক উদ্যোগ আছে, সমবেত আয়োজনের প্রচেষ্টা আছে। সেইসঙ্গে আছে আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনের নিমিত্তে আনা জনবলের প্রতিযোগিতা।

২. বিএনপির এসব জনসমাবেশে দলীয় কর্মী বা ম্যানেজ করে আনা জনতার উপস্থিতি আছে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসা আমজনতার উপস্থিতি নেই। বিএনপি এখন পর্যন্ত নির্বাচনের দাবিতে সাধারণ নাগরিককে তাদের ব্যানারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নামাতে পারেনি। কেননা, বিএনপির কাছে ডিসেম্বরে বা তার আগে নির্বাচন যতটা জরুরি, আমজনতার কাছে সেটা এখনো তত জরুরি মনে হয়ে উঠেনি।

৩. জনসভায় দলের কর্মীরা আসেন, কেননা তারা দলের সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত। তারা দলের নেতাদের নির্দেশ পালন করেন রাজনৈতিক কারণেই। কিন্তু নাগরিকরা দলের কর্মী নন। তারা নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার হানি দেখলে কখনো কখনো নিজের প্রয়োজনেই মাঠে নেমে আসেন বটে, কিন্তু নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ের প্রশ্নে বিএনপি জনতার মধ্যে সেই আবেদন এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি।

৪. তবে, দিন যত যাবে ততই প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে বিএনপি দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের উপস্থিতি প্রকাশ্য হবে। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও তারা প্রবলভাবে যুক্ত হবেন। বিশেষত দেশের পেশাজীবীরা রাজনৈতিক পরিচয়ে মাঠগরম করবেন। এমনকি দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি দলীয় শিক্ষকরাও সরব হবেন নির্বাচনী দাবিতে। সেটা অনেক ক্ষেত্রে এই সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্মকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। দেশের অর্থনীতি ও শাসনক্ষেত্রে অচলাবস্থাও তৈরি করতে পারে।

প্রশ্ন হলো, সেসব পদক্ষেপ দলীয় কর্মীদের বাইরে আমজনতাকে আলোড়িত করবে, নাকি বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ করবে?

৫. বিএনপির আন্দোলন যত জোরদার হবে, ততই টিভি টকশোতে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের বড় নেতারা বিএনপির সুরেই অধিকতর সম্মতি জানাবেন। ছোট দলের বড় নেতারা আগামী নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার অভিপ্রায়েই বিএনপির সঙ্গী হতে চাইবেন প্রাণপণে।

কিন্তু সেটা কি বিএনপির দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে দলীয় কর্মীর বাইরে আমজনতাকে যুক্ত করতে সহায়তা করবে? নাকি এসব নেতাদের মধ্যে জনতা আবিষ্কার করবে ফ্যাসিবাদী আমলে দিলীপ বড়ুয়া, ইনু, মেননদের মুখচ্ছবি। এটা কি বিএনপিকে বাড়তি শক্তি দেবে?

৬. ডিসেম্বরে নির্বাচন না হয়ে জুনে হলে দলের কর্মী নন এমন নাগরিকদের জীবনে তেমন কোনো হেলদোল ঘটবে না। ফলে, বিএনপির ডিসেম্বর নির্বাচন সংক্রান্ত আন্দোলন আরও কঠোর হলেও দলের বাইরের বিপুল সংখ্যক আমজনতা মাঠে নামবে, সেটা আশা করা যায় না।

৭. বিএনপির নেতারা ছোট-বড় জনসভায় নানা কটু ভাষায় ড. ইউনূসকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন। ফ্যাসিবাদী আমলে পতিত স্বৈরাচার যে ভাষায় ড. ইউনূসকে আক্রমণ করতেন, সেই প্রবণতা বিএনপিতে এখন সরব। এটা আমজনতাকে কাছে টানবে, নাকি দূরে ঠেলবে—সেটা একটা প্রশ্ন।

তাহলে কী হবে…

প্রথমত, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে সরকারের নতজানু শাসনব্যবস্থা যদি বিএনপির আন্দোলনের চাপে আরও দুর্বল হয়, তাহলে জনমনে বিপুল আতঙ্ক তৈরি হবে।

দ্বিতীয়ত, ছাত্রদের রাজনৈতিক দল, প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন এমন সাড়ে চার কোটি ভোটার ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়িয়ে বিএনপি একাই যদি নির্বাচনের আগাম সময় নিয়ে বাড়তি চাপ তৈরি করে, তবে একটা বড় রাজনৈতিক বিভাজনের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের আগাম নির্বাচনের বিষয়ে ভারতের রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের চাপকে যদি ভারত-বিএনপি যোগসূত্র বলে প্রচারণা বাড়তে থাকে, সেটাও বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে। নতুন ভোটার ও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সেখানে বিএনপির দূরত্ব বাড়তে পারে।

চতুর্থত, নির্বাচনের সময় ঘোষণায় মাঠ দখল নিয়ে বিএনপি যদি লাগাতার রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সামগ্রিকভাবে অচল করে দিতে চায়, তাহলে সরকারের সমর্থক দেশি-বিদেশি মহলের বিরাগভাজন হয়ে উঠতে পারে বিএনপি।

ফলে, ডিসেম্বরে কিংবা তারও আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিএনপি যদি মরিয়া হয়ে ওঠে, তাহলে রাজনীতিতে অচলাবস্থার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সমঝোতা ছাড়া শুধু চাপ প্রয়োগের রাজনৈতিক কৌশল সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনাকেও বিপদগ্রস্ত করতে পারে।

আবার এই দাবি আদায়ে বিএনপি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটাও তাদের ভোটের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments