নির্বাচন নিয়ে শর্তের বেড়াজাল গ্রহণযোগ্য নয়

বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বাংলাদেশের হারানো সমর্থন ফিরে পেতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের কোনো বিকল্প নেই। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য হলেও আমাদেরকে সর্বোচ্চ জোর দিয়ে নির্বাচনের কথা বলতে হবে।
নিঃসন্দেহে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের পদের জন্য যোগ্যতম। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের জায়গায় এখন এমন একটি নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়া অপরিহার্য, যে সরকার জনগণের স্বাধীন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ক্ষমতায় আসবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নানা শর্ত শোনার পর বিস্ময়ের সঙ্গে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি সত্যিই জাতীয় নির্বাচনের প্রকৃত গুরুত্ব বুঝি? নির্বাচনকে আমরা একটি প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে স্রেফ একটি ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করছি। প্রকৃতপক্ষে এটা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ তাদের দেশ পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব নির্বাচন করে। আমাদের এক মুহূর্তের জন্যও ভুললে চলবে না যে নির্বাচন কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, বরং জনগণের জন্য। 'এই দাবি বা ওই দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হতে পারে না'—এমন কথা বলার অধিকার কোনো দলেরই নেই। ভোটারদের তাদের মৌলিক ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার কারও নেই। এটি সর্বোচ্চ মৌলিক অধিকার এবং প্রত্যেক নাগরিক জন্ম থেকেই এর অধিকারী। ভোট হলো নাগরিকদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রতীক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের জন্য সুফল বয়ে এনেছিল। এই ব্যবস্থার অধীনে আমরা চারটি নির্বাচন পেয়েছিলাম—১৯৯১, জুন ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮—যেগুলো গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছিল। যদিও পরাজিত দলগুলো সব সময়ই ফলাফল নিয়ে অভিযোগ তুলেছে, কিন্তু তারা কার্যত ফলাফল মেনে নিয়ে শাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিল।
তবে, লাগাতার ওয়াকআউট, বয়কট এমনকি পদত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই সংসদকে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত করেছে। সংসদে বিরোধীদলের এমপিদের অনুপস্থিতি ক্ষমতাসীন দলকে সংসদকে নির্বাহী বিভাগের একটি বর্ধিত অংশ হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছে। সংসদকে তার যথাযথ ভূমিকা পালনে বাধা দেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলকে অবশ্যই দায়ী করতে হবে। তবে হ্যাঁ, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে সংসদকেই দুর্বল করে দেওয়ার দায় বিরোধী দলকেও নিতে হবে।
নির্বাচনে কারচুপি করা ছিল শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় অপরাধগুলোর একটি। তিনি কেবল জালিয়াতির নির্বাচন করেননি, বরং গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছেন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন এবং নির্বাচনকে সন্দেহ করার মতো একটি ব্যাপারে পরিণত করেছেন, অথচ যেটা কিনা জনমত বোঝার যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
পরপর তিনবার এই কাজ করার মাধ্যমে পূর্ববর্তী সরকার সংসদকে একটি 'রাবার স্ট্যাম্প' প্রতিষ্ঠানে এবং সংসদ সদস্যদেরকে আজ্ঞাবহ কর্মচারীতে পরিণত করেছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমপিরা উন্নয়ন তহবিল আত্মসাৎসহ বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে তাদের দলীয় প্রধানের ইচ্ছা পূরণ করতেন। নির্বাহী বিভাগের ওপর তদারকি করার পরিবর্তে তার 'অনুগত সেবক' হয়ে গিয়েছিল সংসদ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিএনপিসহ সব দলের মধ্যে (নোট অব ডিসেন্টসহ) একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। বিএনপি প্রত্যাশা, নিম্নকক্ষের যে দলের যত আসন থাকবে উচ্চকক্ষেও সেটাই হবে। তব অন্যরা উচ্চকক্ষে চায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর)।
বিএনপির দাবি হলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। অনেকের মতে (সবাই নয়), গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা কিংবা জনগণের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে বিএনপির আগ্রহ নেই, বরং তারা পরিস্থিতির সুবিধা নিতে নির্বাচন চাইছে। দলটির নেতাদের ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে, তাদের জন্য ততই মঙ্গল। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে—দলটির আশঙ্কা—ততই তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। কারণ তাদের কিছু নেতাকর্মী ইতিমধ্যে এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, যা আগের ক্ষমতাসীন দলের জন্য বদনামের কারণ হয়েছিল।
দেশের নবীনতম রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনে করে, নির্বাচন যত দেরিতে হবে, জনসমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা তাদের ততই বাড়বে। তাই তারা নির্বাচনের দিনক্ষণ মেনে নিলেও, নির্বাচনের আগে 'জাতীয় ঐকমত্য কমিশন' প্রণীত 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। তারা চায়, সংবিধান বা যেকোনো আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে জুলাই সনদ। তাদের এই দাবি একটি অসাংবিধানিক আবদার। এটা একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে। তাই এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের তোলা প্রশ্নকে আমরা যৌক্তিক বলেই মনে করি। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন—রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার একটি দলিল কি সংবিধানের ওপর স্থান পেতে পারে?
জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের সময়সূচি সমর্থন করলেও তারা এমন একটি নতুন দাবি তুলেছে যা একই সঙ্গে জটিল এবং জনগণের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে একমত হলেও জামায়াতের দাবি, নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ—উভয় নির্বাচনই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে। অতীতে, জামায়াত মোট ভোটের যত অংশ পেয়েছে, সেই অনুপাতে আসন পায়নি। ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতি (এফপিটিপি) পদ্ধতির বদলে পিআর পদ্ধতি চালু হলে তারা বেশি আসন পাবে বলে আশা করছে। তাদের এই দাবির পেছনে এটাই মূল কারণ।
পিআর পদ্ধতির একটি বড় দুর্বলতা হলো, জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে না। এক্ষেত্রে দলকে ভোট দিতে হয়। ফলে প্রার্থী ও ভোটারের মধ্যে সরাসরি কোনো সংযোগ থাকে না। এতে একজন ভোটার প্রার্থীকে তার যোগ্যতা, সততা, সক্ষমতা ও মানবিক গুণাবলির ভিত্তিতে বেছে নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। আমাদের দেশে মানুষ সাধারণত এমন প্রার্থীকে ভোট দিতে পছন্দ করেন, যাদের তারা চেনেন এবং জবাবদিহির জন্য বাধ্য করতে পারেন। নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে একজন সংসদ সদস্যের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এটিই মানুষকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করে।
বিশ্বে পিআর পদ্ধতির প্রচলন এত কম কেন? কেন বেশিরভাগ দেশ সরাসরি প্রার্থী নির্বাচন পদ্ধতি পছন্দ করে? জার্মানি ও ইসরায়েল ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশেই পুরোপুরি পিআর পদ্ধতি নেই। নেপালে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর ২৭৫ জন সংসদ সদস্যের নিম্নকক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। দেশটিতে ৬০ শতাংশ (১৬৫ জন) সরাসরি এফপিটিপি পদ্ধতিতে এবং বাকি ৪০ শতাংশ (১১০ জন) পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন। বিশ্বজুড়ে এফপিটিপি পদ্ধতি পছন্দ করা হয়। জামায়াতকে এটি মাথায় রাখতে হবে এবং শুধুমাত্র দলীয় স্বার্থে জনগণের ওপর একটি অপ্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
এনসিপিও পিআর দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সদ্য গঠিত হওয়ায় দলটির কোনো নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নেই। তাদের ধারণা, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তারা হয়তো কয়েকটি বাড়তি আসন পাবে। এখানেও তারা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখছে।
আমরা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি—যেটা সব রাজনৈতিক দল দাবি করে, তাহলে সামনের নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদেরকে এমন নির্বাচন করতে হবে যা জনগণ উদযাপন করবে এবং সারা বিশ্ব সম্মান জানাবে।
যেকোনো ঘটনাকে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে জটিল করে তুলতে আমাদের জুড়ি নেই! যদিও আমরা জানি যে এতে গণতন্ত্রের পথে পুনর্যাত্রা বিলম্বিত হতে পারে। আমরা বহুবার এমনটি হতে দেখেছি, তবু শিক্ষা নেইনি। ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আমাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি চ্যালেঞ্জ। এই নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হলে তা কেবল অর্থনৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই ফিরিয়ে আনবে না, বরং বহু প্রতীক্ষিত সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথও প্রশস্ত করবে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হয় এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে যা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে, অথবা তারা সহযোগিতামূলক মনোভাব গ্রহণ করতে পারে যা আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে। আমাদের অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যে, অতীতে আমাদের গণতন্ত্রের পথে যাত্রা বহুবার হোঁচট খেয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমরা গণতন্ত্রের পথে যাত্রাকে আর বাধাগ্রস্ত করতে পারি না।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments