জনগণের ঊর্ধ্বে দলীয় স্বার্থ দেখে নির্বাচনকে কেন অনিশ্চিত করছি?

আবারও আমাদের রাজনীতি সেই 'আত্মঘাতী' জায়গাতেই ফিরে এসেছে, যেমনটা আগেও বেশিরভাগ সময় ছিল। আগের মতোই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আবারও নানা ধরনের অপরিণামদর্শী দাবি তোলা হচ্ছে, আলোচনার টেবিলে প্রাধান্য পাচ্ছে হুমকিস্বরূপ কথাবার্তা এবং সবচেয়ে দুঃখজনকভাবে, গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তোলা হচ্ছে। আমরা অনেকেই বিষয়টি জানলেও প্রবল আশাবাদের কারণে কেউ কেউ উপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু এখন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টাই এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করছেন।
গত মঙ্গলবার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে অ্যধাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সতর্ক করে বলেছেন, 'যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা যত রকমভাবে পারে বাধা দেবে। বাংলাদেশের সত্ত্বাকে গড়ে তুলতে তারা বাধা দেবে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করার। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার, যাতে নির্বাচন না হয়।'
তাহলে কি আমরা আবার সেই আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছি? যদি তাই হয়, তাহলে কেন? কেন আমরা একই পুরোনো ফাঁদে পা দিচ্ছি, একই বিভ্রান্তি ও স্বার্থের জালে জড়িয়ে পড়ছি? দুঃখজনকভাবে, আমরা আগের মতোই একই ভুল করছি—নির্বাচন নিয়ে খেলছি।
আমরা যদি এগোতে চাই, তাহলে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং সবচেয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে শেখ হাসিনার ভুল থেকে শিখতে হবে। আমরা তার শাসনামলকে 'ফ্যাসিবাদী' বলার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করি না এবং সেটা অনেক দিক থেকে সঠিকও। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন আমরা নিজেরাই তার কিছু ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই? নির্বিচারে গ্রেপ্তার, তদন্তে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি ছাড়াই মানুষকে মাসের পর মাস—অনেক ক্ষেত্রে প্রায় এক বছর—কারাগারে আটকে রাখা, ভিন্নমতকে 'ফ্যাসিবাদের দোসর' আখ্যা দেওয়া, মব হামলা সমর্থন দেওয়ার মতো আরও বহু কাজ কেন আমরা এখনো করে চলেছি? অতীতে আমরা আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকরণের নিন্দা জানিয়েছি। অথচ এখন আমরা অন্যপক্ষের প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের বদলি করে দিচ্ছি। এতে করে কেবল প্রহরী আর সুবিধাভোগীদের জায়গা অদলবদল হচ্ছে, কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সহযোগী দলগুলোকে নিষিদ্ধের দাবি। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের মার্চে 'অপারেশন সার্চলাইট' চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি সব ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মাওবাদী চরমপন্থী দল পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়। ২০০৫ সালে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিষিদ্ধ হয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের মাত্র চার দিন আগে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেন হাসিনা—পরে অন্তর্বর্তী সরকার সেই আদেশ তুলে নেয় এবং দলটি এখন আমাদের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবক।
এসব নিষেধাজ্ঞা কি কখনো কাজে এসেছে? এভাবেই কি চলতে দেওয়া উচিত? সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড সফরকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। গুজব ছড়ানো হয়, সাবেক এই রাষ্ট্রপতি চিকিৎসার নাম করে বিদেশ সফর করা ছিল আওয়ামী লীগকে দেশের বাইরে থেকে পুনরুজ্জীবিত করার কৌশল। কিন্তু তিনি চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে এলেন এবং এখন কার্যত শয্যাশায়ী। সার্বিক পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, ভিত্তিহীনভাবে সাজানো এসব গুজব ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধই রয়ে গেছে।
এখন নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। কারণ, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হাসিনা সরকারের 'বৈধতা' নিশ্চিত করেছিল। একই কারণে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যেসব দল ছিল, সেগুলোকেও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে।
এভাবেই কি আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করব—যেটাকে ড. ইউনূস বলছেন ইতিহাসের সেরা নির্বাচন? আমরা কি এমন নির্বাচন চাই, যেখানে প্রতিপক্ষ দলগুলো নিষিদ্ধ থাকবে?
জাতীয় পার্টি বহু বছরের রাজনৈতিক দল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলটি একসময় ক্ষমতাসীন এবং খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয় শাসনামলেই প্রধান বিরোধী দল ছিল। আমরা আজও স্মরণ করতে পারি, ১৯৮০-এর দশকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটি মহাজোট করে গণআন্দোলন শুরু করে, যার মাধ্যমে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরশাসক এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয়। কিন্তু সেই মহাজোটও এরশাদকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং এরশাদ কারাগার থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন। জাতীয় পার্টিও পরবর্তী সংসদে ৩৫টি আসন পেয়েছিল।
যদি জাতীয় পার্টি বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের কোনো নেতার বিরুদ্ধে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অবৈধ ও অযৌক্তিক সুবিধা নেওয়ার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সেই সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণভিত্তিক অভিযোগ উত্থাপন করা হোক, ন্যায়সংগত বিচার প্রক্রিয়া চলুক এবং সেই অনুযায়ী তাদের শাস্তি দেওয়া হোক।
আমরা যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, জাতীয় পার্টিসহ হাসিনা সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের সদস্যদের নিষিদ্ধ করার দাবি আমাদের গণতন্ত্র পুনর্গঠনের সদিচ্ছাকেই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, একইসঙ্গে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাও নষ্ট করবে।
অনেকে মনে করেন, ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার কারণে নয়, বরং নতুন সংসদে বিরোধী দলের চেয়ার দখলে ঠাণ্ডা মাথার রাজনৈতিক পরিকল্পনা থেকেই জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবি এসেছে। যারা এসব দল নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলেছেন তারা হিসাব করছেন যে, জাতীয় পার্টি মূল বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে যেতে পারে; কাজেই সেই সম্ভাবনাকে আগেভাগেই ঠেকানো যাক।
আশির দশকের শুরুতে দুর্নীতি প্রবর্তনকারী, সুযোগসন্ধানী ও নৈতিক মূল্যবোধহীন দল জাতীয় পার্টির প্রতি কোনো ধরনের ভালোবাসা থেকে আমরা এগুলো বলছি না। আমরা এসব কথা বলছি, কারণ আমরা গণতন্ত্র ভালোবাসি এবং দেখতে পাচ্ছি যে, জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রতি বেশি মনোযোগী দলগুলো কীভাবে আমাদেরকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত রাখছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই স্বাধীনতা আছে নিজেদের মতো করে হিসাব করার, জোট করার, নির্বাচন করার এবং নির্বাচনে জয়ী হলে সংসদে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার। কিন্তু বিরোধী পক্ষের ভোট যাতে গণনাতেই না আসে, সেই কারণেই তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে—যা নিশ্চিতভাবেই গণতন্ত্রবিরোধী।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই বুঝতে হবে যে, আজকের বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো পথ হলো একটি যথাযথ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করা, যেখানে নির্বাচিত সংসদ হবে জনগণের ইচ্ছার ভাণ্ডারের প্রতিফলন। নির্বাচন কেবল আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্যই নয়, বরং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিতের জন্যও প্রয়োজন। নির্বাচন ছাড়া আস্থা তৈরি হবে না—যা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পূর্বশর্ত। আর বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কথা মনে করে দেখুন, এটা শুরু হয়েছিল চাকরি সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত একটি সরকার পতনে গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই চাকরির অভাব তরুণদের মাঝে কেবল গভীর ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি ও স্থায়ী করবে। অনেক সূচকই দেখাচ্ছে যে, যেসব ক্ষেত্রে আমরা চোখ ধাঁধাঁনো উন্নতি করেছিলাম, সেখানেও এখন আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কর্মসংস্থান কমছে, দারিদ্র্য বাড়ছে, মানসম্মত শিক্ষায় পিছিয়ে যাচ্ছি, অপরাধ ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, নারীর অধিকারও পশ্চাৎমুখী।
যারা নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন, তাদের নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত—নির্বাচন ছাড়া কীভাবে জনগণের ক্ষমতায়ন সম্ভব? পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া শুরুর একটিই উপায়, আর সেটি হলো জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া—যাতে তারা নির্ধারণ করতে পারে, কে সরকার গঠন করবে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments