মাঠে খাবার আর পানি: স্টেডিয়ামে ফিরছে পুরনো দিনের স্বাদ

এক হাতে খাবারের প্যাকেট, আরেক হাতে পানির বোতল; মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গেটে আজ এমন দৃশ্য যেন এক নতুন অভ্যেস নয়, বরং পুরোনো দিনের এক প্রিয় স্মৃতির প্রত্যাবর্তন। দর্শকের চোখে ঝিলিক দেওয়া হাসি আর নিরাপত্তার কড়া নজরদারির মাঝে এবার এক নতুন বোঝাপড়া, স্মৃতি আর বাস্তবতার মেলবন্ধন।
প্রবীণ এক দর্শক হেঁটে আসছিলেন ধীরে ধীরে, ব্যাগে টুকটাক শুকনো খাবার। গেট পার হওয়ার আগেই মুখে চমকে ওঠা প্রশ্ন, 'আমি তো নিয়মিত খেলা দেখতে আসি। কবে খাবার নিয়ে ঢুকেছিলাম মনে নেই। তবে ঢুকেছিলাম, সেটা মনে আছে। হয়তো ১৫-২০ বছর আগের কথা।'
স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গিয়ে অনেকটা ধুলোমলিন হলেও, অনুভবটুকু অমলিন। কেরানীগঞ্জ থেকে আসা মোহাম্মদ আলিমুল প্রশ্নটা রাখলেনই এক পর্যায়ে, 'শুকনো কিছু নিয়ে ঢুকলে কি খুব সমস্যা?'
সত্যি কথা বলতে, এই প্রশ্নের কোনো ঠিকঠাক উত্তর নেই। বছরের পর বছর ধরে 'নিরাপত্তার স্বার্থে' দর্শকের হাতের খাবার কেড়ে নেওয়ার এক রেওয়াজ চলে এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পক্ষ থেকে। নিয়মটার ব্যাখ্যা? ছিল না কখনোই। এবারের দৃশ্য বলছে, ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব।
স্টেডিয়ামের গেটে এখন পানির বোতলের ক্যাপ খুলে নেওয়া হচ্ছে, নিষেধ নেই চিপস বা চানাচুর নিয়ে প্রবেশে। এমন স্বাধীনতা পেয়ে দর্শকের মুখে ফুটেছে স্বস্তির হাসি।
পুরান ঢাকা থেকে খেলা দেখতে আসা অমিত জানালেন, 'আমরা তো প্রায় সব ম্যাচেই থাকি। এবার সত্যিই স্বস্তি লাগছে। আগের মতো আর অতিরিক্ত দামে খাবার কিনতে হচ্ছে না। এটা সাধারণ দর্শকদের জন্য বড় স্বস্তি। আশা করি এটা নিয়মিত থাকবে।'
আরও আন্তরিক প্রতিক্রিয়া মেলে নবীনগর থেকে আসা রবিনের কণ্ঠে, 'মাঠে আনন্দ মানেই চিৎকার, হৈ-হুল্লোড়। তখন তো পিপাসা লাগবেই। খাবার নিয়ে ঢুকতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার। তবে ক্যাপ (ছিপি) খুলে রাখছে এটা একটু সমস্যা। তবুও ভালো। পানি আগে পাওয়া যেত না ঠিকঠাক, পেলেও দামে মাটি কাঁপিয়ে দিত।'
তানজিমুলের অভিজ্ঞতাও একই: '১০ টাকার খাবারকে ৩০-৪০ টাকা দিয়ে খাওয়াটাই ছিল নিয়ম। এখন বিসিবি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে অনেক দর্শকই সত্যিকার অর্থে উপকৃত হবেন। এর আগে বিপিএলে ফ্রি পানি দিয়েছে, আমি মনে করি শুধু পানি ফ্রি দেওয়ার চেয়ে খাবার-দাবারসহ ঢুকতে দেওয়া অনেক ভালো।'
এই দৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায় একটা সময়, যখন স্টেডিয়ামে ঢোকার আগে ব্যাগে থাকতো ভাঁজ করা পাউরুটি, চানাচুর, কখনো এক বোতল শরবত। এমন দৃশ্য হারিয়ে গিয়েছিল ২০১০ সালে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের সময়, ২০১১ বিশ্বকাপের আগমনী ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে। আইসিসির কড়া নিয়মের ছায়ায়, দেশি আয়োজনও হারিয়ে ফেলেছিল সেই স্পন্দন।
তবে খাবার ও পানি নিয়ে ঢোকার বিপত্তিও রয়েছে অনেক। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেই স্মরণীয় সেমিফাইনাল আজও দৃষ্টান্ত, ভারতের এক দল ক্ষুব্ধ সমর্থক গ্যালারিতে আগুন ধরানোর পাশাপাশি মাঠে বোতল ছুঁড়ে খেলা বন্ধ করে দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সেই বিজয় আজও ক্রিকেট ইতিহাসে আলোচিত। ঠিক এমন ঘটনার হাত থেকে বাঁচতেই খাবার-পানির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে আইসিসি।
তবুও, সময় বদলায়। আর বদলে যায় নিয়মের সংজ্ঞা। এখন বিসিবি সেই পুরনো দিনের দর্শকবান্ধব আচরণে ফিরে আসছে। আবারও স্টেডিয়ামের গেটে দেখা যাচ্ছে প্যাকেট হাতে মানুষ, মুখে তৃপ্তির হাসি।
মাঠে খেলা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, মাঠের চারপাশে বসে থাকা হাজারো মানুষের অভিজ্ঞতাও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। স্টেডিয়ামে খাবার নিয়ে প্রবেশের এই ছোট্ট সুযোগ, হয়তো একদিন হয়ে উঠবে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত। হয়তো এটাও একদিন ইতিহাসে লেখা থাকবে, 'সেদিন, মিরপুরে মানুষ আবার খাবার নিয়ে ঢুকেছিল।'
Comments