কোচ বিদেশি না হলেও বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করা যায়  

Golam Rabbani Choton
সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কোচ গোলাম রাব্বানি ছোটনকে মাথার উপর তুলে ধরেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা। ছবি: সংগ্রহ

জাতীয় ফুটবল দল বা ক্লাব দলের কোচ হিসেবে কোনো বিদেশি এয়ারপোর্টে নামলেই খবর হয়ে যায় – এক জাদুকর এসেছেন, যার স্পর্শে বদলে যাবে দলের খেলার চেহারা।

সেই কোচ হোটেলে ব্যাগ–পত্র রেখে কোনো মতে সংবাদ সম্মেলনে আসতে পারলেই তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় 'আলাউদ্দিনের প্রদীপের দৈত্য'র মতো করে। ভাবখানা এমন যেন – আমরা খালি প্রদীপের গায়ে ঘষা দিয়ে বলব, অমুক দলকে হারিয়ে দাও। বাকি কাজ কোচের বাম হাতের খেল। কিন্তু কাড়ি কাড়ি ইউরো– ডলার –পাউন্ড ঢেলে ফলটা কী হয়, তা সবারই জানা।

বিদেশি কোচের গল্প থেকে এবার দেশি কোচের গল্পে আসি। প্রায় এক যুগ ধরে নারী জাতীয় ফুটবল দলের কোচ স্থানীয় গোলাম রব্বানী ছোটন। নারী ফুটবলের সাফল্যের ভাণ্ডারের কাণ্ডারি তিনি। তবুও কিনা ছোটনকে দেশের তথাকথিত নাক উঁচু ফুটবল সমাজের মেনে নিতে কষ্ট হয়। তাদের ভাবখানা এমন যে, বিদেশি না হলে কি আর ভালো কোচ হওয়া যায়!

Sabina khatun & Golam Rabbani Choton
অধিনায়ক সাবিনাকে কৃতিত্ব দিলেন কোচ ছোটন

প্রায় হাফ ডজন আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের পরেও দেশি কোচদের নিন্দুকেরা ছোটনের সাফল্যের বিপক্ষে গিয়ে পাল্টা যুক্তি দেন, 'ছোটন শুধু বয়সভিত্তিক ফুটবলেই জিততে পারে। বড়দের সঙ্গে গিয়ে আর পারে না।' হিমালয় জয় করে সেই নিন্দুকদের মুখেও এবার ঝামা ঘষে দিলেন বাংলাদেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা ছোটন। তাও আবার দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে।

Rashedul Islam
রাশেদুল ইসলাম।

এখনো পুরো দেশ মেতে আছে মেয়েদের সাফ জয়ের আনন্দে। এর বড় অংশ জুড়ে বরাদ্দ থাকা উচিত ছিল দলের কোচ ছোটনের জন্য। কারণ কথাই তো আছে 'ফুটবল কোচ গেম'। কিন্তু ছোটনকে নিয়ে সেই আলোচনাটা কি হচ্ছে! আমার দৃষ্টিতে না।

তাকে কিছুটা আলোচনায় রেখেছে ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের দুই লাইনের সেই বক্তব্য, 'যখন আমি কোচিং শুরু করি তখন আমার বন্ধুরা বলতো ওই যে মহিলা কোচ যাচ্ছে। রাস্তায় যখন হেটে যেতাম আমাকে দেখে হাসাহাসি করতো। ঠাট্টা করতো আমাকে নিয়ে।' অর্থাৎ আলোচনার বিষয় বস্তুতে ছোটনের বীরত্বের কোনো গল্প নেই। ওই যে ছোটন তো বিদেশি নন। স্বাভাবিকভাবে বিদেশি কোচদের মতো ঘাড় ঝাঁকি দিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে কথাও বলতে পারেন না তিনি। শুধু তাই নয়, বিদেশি কোচ না হলে আমাদের সাক্ষাতকার পর্বও নাকি জমে না!

অথচ ছোটনের ফুটবল নিবেদনের গল্পটা শুনলে আপনি চমকে উঠতে পারেন। ২০১৪ সালে ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে হুট করেই ছোটনের জামালপুরে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়া এবং পছন্দ হয়ে যাওয়ায় বিয়ে। কিন্তু ছোটনের তো মন পড়ে আছে ঢাকায় তার দলের কাছে। তাই কোনো রকম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাসর না করেই ঢাকায় ছুট! বাফুফে ভবনে সে গল্পটা ছোটনের মুখ থেকেই শুনেছিলাম,  'সকালের অনুশীলনটা যেন মিস না হয়, তাই সে রাতেই ঢাকা চলে আসি।'

দুর্দান্ত খেলেও সেবার ইরানের কাছে হেরে সেবার গ্রুপ পর্ব উৎরাতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু কৃষ্ণা রাণী সরকার, সানজিদা আক্তারদের ঘিরে মেয়েদের ফুটবলে নতুন সূর্যোদয়ের আভাস দেখা মিলেছিল সে আসরেই। প্রায় আট বছরের ব্যবধানে সেই সূর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলে।

এছাড়া ছোটন মাঠে যা করেন, তার অর্ধেক কোন বিদেশি কোচ করলে সেগুলো আলাদাভাবে হয়ে যেতো চর্চার বিষয়বস্তু। নিজের ছোট একটা কোচিং লাইসেন্স আছে। দেশি ও বিদেশি বেশ কয়েক জন কোচের অধীনে খেলেছি। সে সূত্রে কিছুটা হলেও বুঝি, মাঠে কোচিং ডেলিভারি কতটা গুরুত্বপূর্ণ । আমার দৃষ্টিতে কোচিং ডেলিভারিতে কোচ ছোটন লেটার মার্কস পাবেন। ডাগ আউটে সে যেন মুখে মাইক বেঁধে দাঁড়ান!

তবে ছোটনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটা বোধহয় ব্যক্তিত্ব। যে সমাজে পান থেকে চুন খসলেই রেহাই নেই, সেখানে প্রায় এক যুগ ধরে নারীদের কোচ হওয়া ছোটনের ব্যাপারে কোন ফিসফাস নেই। অধিনায়ক সাবিনা খাতুন মাঠ থেকে উঠে এসে ছোটনের বুকে মাথা রাখেন। বাবার মমতায় সে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন ছোটন। এই ভরসার জায়গা তিনি অর্জন করে নিয়েছেন।

ছোটন কখনো শান্ত বাবা। আবার খেলোয়াড়েরা ভুল করলে কখনো বকা দেওয়া, আবার পরক্ষনেই পিঠ চাপড়ে দেওয়া। এমন কত মধুর দৃশ্য কাছে থেকে দেখা। পরিবারের কড়া অভিভাবক হয়ে ওঠার দৃশ্যও তো কম দেখা হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে কলসিন্দুরের মেয়েদের আলাদা করে সম্বোধন করা হলে ছোটন দায়িত্ব নিয়ে বলে ওঠেন, 'আমার সব মেয়েরাই বাংলাদেশের।'

এভাবে দেশের আনাচে কানাচে থেকে উঠে আসা মেয়েরা ছোটনের হাতের তালুতে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানচিত্র। যারা মাঠে বাংলাদেশকে জেতাতে হয়ে ওঠে যোদ্ধা । সাফে ছোটনের দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এবার অন্তত বলি, বিদেশি না হলেও বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করা যায়।

লেখক: ম্যানেজার, ফর্টিস এফসি লিমিটেড ও  সাবেক ক্রীড়া সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago