১৯৭৯ থেকে ২০২৫: একই গৌরব, একই কান্না

১৯৭৯ সাল। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের বয়স তখন মাত্র ৯। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ঘরবাড়ি গুছিয়ে নেওয়ার মাঝেই দেশের মানুষ এক টুকরো আনন্দ খুঁজে পায় ফুটবলে। সংগঠিত কাঠামোর অভাব, আন্তর্জাতিক ম্যাচের অভিজ্ঞতা প্রায় শূন্য। তবুও লাল-সবুজের হৃদয়ে তখন ফুটবল এক অবিচ্ছেদ্য আবেগ। ঠিক এমন এক সময়, ঢাকার বুকে বসে যায় এশিয়ান কাপের বাছাই পর্ব। জাতীয় দলের ইতিহাসে এত বড় টুর্নামেন্ট এর আগে কখনোই দেশে আয়োজিত হয়নি। সবার চোখ তখন ঢাকা স্টেডিয়ামের দিকে। অতিথি দল কাতার আর আফগানিস্তান। প্রস্তুতির ঘাটতি, পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা কিছুই থামাতে পারেনি বাঙালির ফুটবল স্বপ্নকে। প্রাণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের মূলপর্বে জায়গা করে নেয়। একটি অর্জন, যা আজও আমাদের গর্ব আর ভালোবাসার এক অমলিন স্মৃতি।
তখনকার দিনে টেলিভিশন ছিল বিলাসিতা। সাদাকালো স্ক্রিনে ১৪ ইঞ্চির একটা টিভি থাকলেও পুরো মহল্লা জড়ো হতো সেটার সামনে। অনেক জায়গায় এমন টিভিও ছিল না, রেডিওই ছিল ভরসা। আর যারা সুযোগ পেতো মাঠে যাওয়ার, তাদের অনেকে টিকিট না পেয়ে দেয়াল টপকে, গাছের ডালে উঠে খেলা দেখতো। গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো ঘণ্টা কয়েক আগেই। স্টেডিয়ামের বাইরে থাকতো স্টেডিয়ামের সমান ভিড়। পুলিশও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হতো, এমনকি টিয়ার গ্যাসও ব্যবহার করতে হতো জনতাকে সামাল দিতে।
তখনকার একেকটি ম্যাচ ছিল যেন একেকটি উৎসব। সে সময়ের কিংবদন্তিরা একেকজন হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত চরিত্র—সালাহউদ্দিনের জাদুকরী ড্রিবলিং, চুন্নুর অসাধারণ গোল, বাবলুর থ্রু-পাস কিংবা ইউসুফের শক্ত প্রতিরক্ষা—এসবই হয়ে যায় লোককথার মতো। সেই সময়ের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার মোহাম্মদ আবু ইউসুফও বললেন তাই, 'তখনকার সময়ে ফুটবলের যে উচ্ছ্বাস, জনপ্রিয়তা ছিল তা যদি এখন বলি, তাহলে তো সবাই বলবে গল্প বলতেছি। জাতীয় দল আর মোহামেডান-আবাহনীর খেলা মানেই ছিল ঈদের মতো আনন্দ। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী থেকে গাড়ি বোঝাই করে লোকজন ঢাকায় চলে আসতো। তখন যতো লোক স্টেডিয়ামের ভিতরে থাকতো, ততো লোক বাহিরে থাকতো। টিকিট না পেয়ে লোকজন জোর করে ঢুকত। ঘোড়ায় চড়ে পুলিশ তখন তাদের সামলাতে পারতো না। এমনও আছে তাদের সামলাতে টিয়ার গ্যাসও ব্যবহার করতে হয়েছে।'
এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের সেই স্মৃতি মন্থন করতে গিয়ে আবেগি হয়ে উঠলেন এশিয়ান কাপে ওপেন প্লেতে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুও, 'আসলে ঐ সময় আমাদের এতো কিছু ভেবে হয়নি। সেটা হয়ে গেছে। কাতারের সঙ্গে ম্যাচ ছিল, আর আফগানিস্তানের সঙ্গে। কাতারের সঙ্গে ড্র করলাম আর আফগানিস্তানের সঙ্গে জিতেছিলাম। আমরা আসলে খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম তখন। তখন কিন্তু সাদাকালো টিভির যুগ ছিল বাংলাদেশে, আমাদের বলা হয়েছিল যদি তোমরা যদি এশিয়ান কাপে যেতে পারো তাহলে তোমাদের প্রত্যেককে ১৪ ইঞ্চি টিভি দেওয়া হবে। এবং পরবর্তী সময়ে তা আমাদের দেওয়া হয়েছিল।'
১৯৭৯ সালে এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে প্রথম ম্যাচে আব্দুল হালিমের জোড়া গোলে আফগানিস্তানের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ। এরপর কাতারের সঙ্গে ১-১ ড্র। এরপর আফগানদের বিপক্ষে ফিরতি ম্যাচে রীতিমতো বাঁচা-মরার লড়াই। জয় মানেই এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্ব, পরাজয় মানেই বিদায়। সেই লড়াইয়ে ৩-২ গোলের দুর্দান্ত জয় এনে দেয় চূড়ান্ত পর্বের টিকিট। যদিও শেষ ম্যাচে কাতারের কাছে ৩-১ গোলে হারতে হয়। চূড়ান্ত পর্বে কোনো জয় না এলেও উত্তর কোরিয়া ও সিরিয়ার বিপক্ষে লড়াই করে হার এবং ইরান-চীনের কাছে বড় ব্যবধানে পরাজয় ছিল। তবু সেই অভিযাত্রা হয়ে আছে লাল-সবুজের ফুটবল ইতিহাসের এক গৌরবগাথা।
মূল মঞ্চে ভালো করতে না পারার পেছনে কারণ ব্যাখ্যা করলেন ইউসুফ, 'আমরা খেলেছি কাদের সঙ্গে, ইরানের মতো দলের বিপক্ষে। যারা নিয়মিত বিশ্বকাপে খেলে। বাকি যারা আছে তারাও মাঝেমধ্যেই বিশ্বকাপে খেলে। এর আগেও আমরা দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইরাক এদের সঙ্গে খেলতাম। ওরা আমাদের আমন্ত্রণও জানাইতো। কিন্তু তাদের সঙ্গে খেলতাম বলেই আমাদের র্যাঙ্কিং পিছিয়ে ছিলাম। এখন বাংলাদেশ যাদের সঙ্গে খেলে তাদের বিপক্ষে তো খেলতামই না। এরা একেবারেই নিচের সারির। যা দুই একটা খেলতাম সেখানে আমরা খুব বড় ব্যবধানে জিততাম। এখন তো আমাদের কোয়ালিফায়ারের কোয়ালিফায়ার খেলতে হয়।'
তবে মূল পর্বে ভালো করতে না পারলেও বিন্দুমাত্র কমেনি ফুটবলের উচ্ছ্বাস। বরং আরও বেড়েছিল। শুধু দলেরই নয়, প্রত্যেক খেলোয়াড়েরও ছিল তুমুল জনপ্রিয়তা, তারকা খ্যাতি। প্রত্যেকেই দেশের জন্য খেলতে নিজেদের উজাড় করে দিতেন বলেই জানান চুন্নু, 'তখন আমাদের জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। দলের প্রত্যেকেই প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে এটা হারায় গেলো। তখন কে আবাহনীতে খেলত, কে মোহামেডানে খেলত এইসব কিছু না ভেবে সবাই দেশের জন্য ঝাঁপায় পরত সবাই। ফুটবলটা তখন যা ছিল তা আনপ্যারালাল, অবিশ্বাস্য। তা আসলে বলে বুঝানো যাবে না।'
কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই জনপ্রিয়তায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে। তবে এরমধ্যে ৪৬ বছরের দীর্ঘ এই সময় পর আবারো এশিয়ান কাপের মূল মঞ্চে পৌঁছেছে বাংলাদেশের একটি দল। অস্ট্রেলিয়ায় ২০২৬ সালের মার্চে অনুষ্ঠিতব্য নারী এশিয়ান কাপের মূল আসরে প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিত্ব করবে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। মেয়েদের এই অর্জনে উচ্ছ্বসিত গোটা দেশ। চারদিকেই প্রশংসা আর অভিনন্দনের জোয়ার। দেশের সবাই নিজেদের গর্বের অংশ হিসেবে দেখছেন এই অসাধারণ সাফল্যকে।
এই সাফল্যে গর্বিত প্রথম এশিয়ান কাপে খেলা নায়কেরাও। সাবেক মিডফিল্ডার হাসানুজ্জামান বাবলু বললেন, 'এই দেশে নারী ফুটবলের কোনো চর্চা নাই। শুধু মাত্র ফুটবল ফেডারেশন গত ১৫ বছর যাবত এই মেয়েদেরকে নার্সিং করে একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে। একটা সময় যে মেয়ে ফুটবল খেলত, সেই ক্রিকেট খেলত, সেই অ্যাথলেটিক্স করতো, সেই হ্যান্ডবল খেলত, সমস্ত জায়গায় সেই একই মেয়ে। সেই দিন পেছনে ফেলে গত ১৫/২০ বছরে মেয়েরা একটা পর্যায়ে এসেছে। যারা বলে লাথি দিতে পারতো না তারা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এবার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করছে। এটা আমাদের জন্য অহংকারের জায়গা। বাংলাদেশি একজন ফুটবলার হিসেবে আমার কাছে অহংকারের জায়গা। আমাদের মেয়েরা, হত দরিদ্র ঘর থেকে উঠে আসা। আমাদের মেয়েরা তাদের শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে এই এচিভমেন্টটা করেছে। ইতিহাস তো তৈরি হয়, তারা এই ইতিহাস তৈরি করেছে।'
এতো কিছুর মাঝেও আক্ষেপ ঝরল দেশের সেই সময়ের নায়কদের কণ্ঠে। মূলত ফুটবল এখন আরও অনেক এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে উল্টো পথে গিয়ে তো হারিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। এরজন্য কর্মকর্তাদের দায় দিলেন বাবলু, 'আমরা সেই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছি যখন ফুটবল তুমুল জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে পতন হতে শুরু করে, এর অনেক কারণ আছে। এটা মূলত রাজনৈতিক কারণে হয়েছে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা তাদের রাজনীতিকরণের জন্য ব্যবহার করেছে। যে কোনো ছোট খাট যে সাফল্যকে নিজেদের এচিভমেন্ট দেখাতে গিয়ে মূল বিষয় হারিয়ে দিয়েছে। ১০ ম্যাচের মধ্যে একটা জিতলেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, দেশের ফুটবল পাল্টে গেল, আগামীতে বিশ্বকাপ খেলে ফেলবে। এই যে যারা ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা টিকায় রাখতে এইসব বিভিন্ন স্ট্যানবাজি করছে, এই সব কারণে ধ্বংস করে ফেলেছে। এখন আমাদের যে সব সাফল্য হয়, সেটাকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতিকরণ যেটা করা হয় সেটাতে আমার একটা দুঃখের জায়গা, ক্ষোভের জায়গা।'
চুন্নু অবশ্য বললেন তখনকার কর্তা ব্যক্তিদের অনভিজ্ঞতার কথা, 'তখনকার সেই সময়ে ফুটবল যে জনপ্রিয় ছিল কিন্তু সেটা তখনকার কর্মকর্তারা কেপিটালাইজ করতে পারে নাই। পারে নাই এই জন্য তাদের সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তারা মনে করছে যেভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এইভাবেই মনে হয় ফুটবলও এগিয়ে যাবে। এটার জন্য যে একটা প্ল্যান থাকা দরকার, একটা টার্গেট থাকা দরকার সেটা তারা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেনি। যারজন্য ঐ জনপ্রিয়তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে।'
তবে মেয়েদের এই সাফল্যকে কেন্দ্র করে ফুটবল যেন আগের জায়গায় ফিরতে পারে সেই আকুতি জানালেন এই সাবেক তিন তারকাই। এরজন্য সবার আগে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন ইউসুফ, 'আমাদের ফুটবলের জনপ্রিয়তা এখনও আছে। তবে এখন আমাদের সময়ের মতো হিরোরা নাই। কাকে নিয়ে এই সমর্থক মাথায় তুলে নাচবে। এরজন্য সবার আগে জানতে হবে কেন আমরা খেলব। আজকাল মানুষ তো খেলতেই যায় না। শারীরিক চর্চাই নাই। সবার আগে তো মাঠে যেতে হবে। অবশ্য সেই মাঠও নাই। আগে যে স্কুলে স্কুলে খেলাধুলা হতো সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি বার্ষিক একটা যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সেটাও হয় না। হলেও সেটা কাগজে কলমেই থাকে। তো আগে ছেলে-মেয়েদের মাঠে নিতে হবে। এরজন্য যারা ক্ষমতায় আছে তাদের আগে আগায় আসতে হবে।'
এছাড়া নতুন ফুটবল ফেডারেশনের কাছে সঠিক পরিকল্পনার আহ্বান জানান চুন্নু, 'এরজন্য চাই সঠিক পরিচালনা এবং সঠিকভাবে এগোনো এবং পাশাপাশি দরকার দীর্ঘমেয়াদী প্ল্যান। এই অল্পতেই যেন আমরা সন্তুষ্ট হয়ে না যাই। এটাকে আমি মনে করব অল্প। এটাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। যেটা দীর্ঘমেয়াদী একটা প্ল্যান থাকবে, যার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে। শুধু ঢাকায় না সারা দেশে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা করতে হবে। পরিকল্পনা ঠিক থাকলে সবই সম্ভব।'
আর এটাকে নতুন ফেডারেশনের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বাবলু, 'আমি আশা করব বর্তমান যে কমিটি এসেছে তাদের হাত ধরে সাফল্য আসবে, মেয়েদের হাত ধরে এই শুভ যাত্রাটা শুরু হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা ফুটবল ফেডারেশনের একটা চ্যালেঞ্জ। এবং এইটা যদি করতে পারে, পাশাপাশি ছেলেদের ফুটবল দুইটা ম্যাচ হয়েছে বাকি ম্যাচে যদি ভালো কিছু করতে পারে, কোনোভাবে যদি ভালো রেজাল্ট আসে তাহলে ফুটবল আবার ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রচেষ্টা সেটা সফল হবে।'
এই দুই সাফল্যের মাঝের দীর্ঘ সময় ধরে বারবার উচ্চারিত হয়েছে একটি কথা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব। এবং সেই একটি প্রশ্নই বারবার উচ্চারিত হয়, আমরা কি পারব সত্যিই এই সাফল্য ও অগ্রগতিকে কাজে লাগাতে?
Comments