প্লাস্টিক যেভাবে পরিবেশ দূষণ করে

২০২০ সালেই বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক শিল্প থেকে ১.৮ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণ গ্যাস বের হয়েছে।
প্লাস্টিক যেভাবে পরিবেশ দূষণ করে

একসময়ের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার প্লাস্টিক এখন পরিবেশ দূষণ নামের দুঃস্বপ্নের শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অপব্যবহার এবং অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এই দূষণের প্রক্রিয়া ঠিক কীভাবে কাজ করে, তা আরও ভালো করে বুঝতে কিছু তথ্য-উপাত্ত দেবার মাধ্যমে এ সমস্যার ভয়াবহতা ও সামগ্রিক চিত্রটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। 

নিষ্কাশন এবং উৎপাদন

প্লাস্টিকের জীবনচক্রের প্রথম ধাপ শুরু হয়ে জীবাশ্ম জালানি, অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস নিষ্কাশনের মধ্য দিয়ে। এই অনবায়নযোগ্য শক্তি উৎসগুলোকে প্লাস্টিক উৎপাদনের কাঁচামাল, যেমন– ইথিলিন ও প্রোপিলিন পেতে ব্যবহার করা হয়। এই নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার ফলে বায়ু ও পানি দূষণ হয় এবং এর ফলে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড়সড় ঘটনা ঘটে। 

সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রেনমেন্টাল ল বা আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৯৯ শতাংশ প্লাস্টিকই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। শুধু ২০২০ সালেই বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক শিল্প থেকে ১.৮ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণ গ্যাস বের হয়েছে, যা কি না ৩৮০টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ও প্যাকেটজাতকরণের সমান। 

একবার কাঁচামাল পাওয়া হয়ে গেলে সেগুলোকে একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এভাবে প্লাস্টিক পলিমার তৈরি হয়। এরপর নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধির জন্য এর সঙ্গে প্লাস্টিসাইজার, রঞ্জকদ্রব্য এবং স্থিতিশীলকারীর মতো সংযোজনকারী পদার্থ মেশানো হয়। উৎপাদনের এই ধাপে অনেক শক্তি ও পানির যোগান দিতে হয়, যা কার্বন নিঃসরণ এবং জলসংকটের কারণ। 

প্লাস্টিক প্যাকেজিং প্লাস্টিক ব্যবহারের অন্যতম ক্ষেত্র এবং বছরের পর বছর ধরে এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। এলেন ম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশনের মতে, শুধু প্লাস্টিক প্যাকেটের উৎপাদনেই ২০২০ সালে ১৪৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্রয়োজন হয়েছে। এই পরিমাণ বিশ্বব্যাপী মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় প্রায় ২৮ শতাংশ। 

ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনা

প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের বিস্তৃত ব্যবহারের মধ্যে থাকা একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী উপকরণ, সবই পরিবেশ ক্ষয়ের অন্যতম অবদান রাখে। এসইউপি বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার এখন সর্বব্যাপী, বিশেষ করে একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগ, স্ট্র এবং বোতলের মতো দ্রব্যাদি। 

মূল সমস্যাটা হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে। একটি বড় পরিমাণের প্লাস্টিক বর্জ্য গিয়ে জমা হয় ভাগাড়ে, যেগুলো পচতে সময় গেলে যায় বছরের পর বছর। এ ছাড়া অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে একটি মোটামুটি পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্যের গন্তব্য হয় জলাশয়গুলো, যার জের ধরেই ক্রমবর্ধমান সমুদ্র দূষণের সমস্যাটি আরও বৃদ্ধি পায়। 

পরিবেশগত প্রভাব

পরিবেশে প্লাস্টিকের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং বিধ্বংসী।

সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র

সমুদ্র যেন প্লাস্টিক বর্জ্যের এক বিশাল মজুদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এতে করে বিপর্যস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক জীবন। জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৮ মিলিয়নেরও বেশি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতি বছর সমুদ্রে প্রবেশ করে। এই প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য বিশাল হুমকির রূপ নেয়, কেন না তারা প্রায়ই ভুল করে প্লাস্টিককে খাবার মনে করে বা বিভিন্নভাবে তাদের শরীর প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।

ভূমি ও মাটি দূষণ

প্লাস্টিক বর্জ্যের ফলে মাটি দূষিত হয় এবং এতে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে জীবজগত ও উদ্ভিদকূল উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাটির উর্বরতা ব্যাহত হয়, কৃষি উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং বাস্তুতন্ত্রের সুস্থতা বিঘ্নিত হয়। 

বায়ু দূষণ
 
প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ফলে পরিবেশে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায়, যার ফলে বায়ু দূষণ ঘটে এবং পরবর্তীতে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগব্যাধির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। 

মাইক্রোপ্লাস্টিকের দীর্ঘস্থায়িতা

প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে ভয়ের দিকটি হচ্ছে এর দীর্ঘস্থায়িতা। প্লাস্টিকের পচনে বহু বহু বছর কেটে যায় এবং বহু বছর পরও এটি ভেঙে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক নামের ক্ষুদ্রাংশে পরিণত হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ৫ মিলিমিটারের চেয়েও কম এবং সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে যে বাতাসে আমরা শ্বাস নিই– তার সবখানেই এখন মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এই ছোট ছোট কণাগুলো খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্ম দেয়। 

 

অনুবাদ: অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments