ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক থেকে টাইলস

প্লাস্টিক বর্জ্য ময়লার ভাগাড়ে রেখে দিলে বা লেক, নদী বা সমুদ্রের সংস্পর্শে এলে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। গত এক বছর ধরে ৫০ বছর বয়সী নাজির হোসেন এসব প্লাস্টিক বর্জ্য ফুটপাত, ছাদ ও টয়লেটে ব্যবহারের উপযোগী স্বল্প খরচের টাইলসে রূপান্তরিত করে আসছেন।
প্লাস্টিকের টাইলস। ছবি: স্টার
প্লাস্টিকের টাইলস। ছবি: স্টার

দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং দিন দিন পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। সম্প্রতি এ সমস্যার সমাধানে একটি ছোট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য ময়লার ভাগাড়ে রেখে দিলে বা লেক, নদী বা সমুদ্রের সংস্পর্শে এলে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। গত এক বছর ধরে ৫০ বছর বয়সী নাজির হোসেন এসব প্লাস্টিক বর্জ্য ফুটপাত, ছাদ ও টয়লেটে ব্যবহারের উপযোগী স্বল্প খরচের টাইলসে রূপান্তরিত করে আসছেন।

তার কর্মজীবনে প্লাস্টিক বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি ৯০ এর দশকের শুরু থেকে প্রায় ২০ বছর টানা একটি প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করেন। ২০২১ সালে তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন আকারের প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ তৈরির ব্যবসা শুরু করেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম দেন হোসেন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। এটি কামড়াঙ্গীরচরে অবস্থিত।

একদিন তার মাথায় নতুন এক চিন্তা এল।

'আমি খেয়াল করলাম, আমার ওয়ার্কশপের সামনের ফুটপাতটি মাটির টাইলস দিয়ে তৈরি। তারপর আমি চিন্তা করলাম, আমরা যদি ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক এই ছাঁচে ব্যবহার করি, তাহলে টাইলস বানাতে পারব', যোগ করেন তিনি।

তবে তিনি এ প্রক্রিয়াটি ঠিক কী রকম হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। তাই তিনি রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার (আরআইসি) নামে একটি স্থানীয় এনজিওর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য যোগাযোগ করেন।

আরআইসি, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের টেকসই উদ্যোগ প্রকল্পের মাধ্যমে তার এই অভিনব প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নে সহায়তা করে।

'তারপর আমি একটি ছাঁচ তৈরি করলাম এবং প্লাস্টিকের টাইল বানাতে শুরু করলাম। আমি ২০১২ থেকে প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ তৈরি করে আসছি। এ কারণে আমার কাঁচামাল জোগাড়ে কোনো সমস্যা হয়নি', যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, প্লাস্টিকের টাইলসগুলো ওজনে হালকা এবং মাটি বা সিরামিকের টাইলসের চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে।

এ পর্যন্ত তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ১ হাজারেরও বেশি টাইলস তৈরি করেছেন এবং এগুলো আজকে থেকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক মেলায় প্রদর্শিত হবে।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও দূষণ, উভয়ের পরিমাণই খুব দ্রুত বাড়ছে। দেশের নগর অঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ২০০৫ এর ৩ কেজি থেকে বেড়ে ২০২০ এ ৯ কেজি হয়েছে। ১৫ বছরের ব্যবধানে এটি ৩ গুণ বেড়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৭০ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থা হয় এক বার ব্যবহার উপযোগী পণ্য, যেমন শপিং ব্যাগ, প্যাক করার উপকরণ ও র‍্যাপার নিয়ে। 

জাতীয় টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইকেল করা, ২০২৬ এর মধ্যে ৯০ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য থেকে সরে আসা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নাজির হোসেন প্লাস্টিক টাইলস তৈরির পর এর গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য কিছু নমুনা টাইলস বুয়েটের গবেষণাগারে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।

বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম আকন্দ জানান, (টাইলস নিয়ে) আমাদের প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে ভালো, তবে আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে।

'তবে একটি বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, প্লাস্টিকের টাইলস সিরামিক টাইলসের বিকল্প হতে পারে না। উভয়ের সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। তবে প্লাস্টিক টাইলস সিরামিক বা মাটির টাইলসের চেয়ে বেশি টেকসই', যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক সালাম আরও জানান, প্লাস্টিক টাইলসের ব্যবহার নিঃসন্দেহে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সহায়তা করবে।

বিশ্বে প্লাস্টিক টাইলসের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে প্লাস্টিক দূষণের ব্যবস্থাপনায় এই পণ্য ব্যবহার শুরু করেছে।

এই টাইলসগুলো সিরামিক বা মাটির তৈরি টাইলসের তুলনায় অপেক্ষাকৃত টেকসই, হালকা এবং এগুলো পরিবহণ ও স্থাপন করা সহজ হওয়ায় ভারত, মিশর, কেনিয়া ও অন্য কিছু দেশ ইতোমধ্যে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু করেছে।

হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা নাফিজুর রহমান জানান, তিনি প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তৈরি টাইলসের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী, কারণ সাধারণত এ ধরনের পণ্যগুলো সিরামিক বা মাটির তৈরি টাইলসের চেয়ে বেশি টেকসই হয়।

তিনি বলেন, 'আমরা পণ্যটি দেখেছি। আমরা এখন এই টাইলসগুলো আমাদের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখার পরিকল্পনা করছি।'

তিনি আরও জানান, পরীক্ষা ঠিক মতো হলে এর মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে।

নাজির হোসেন জানান, প্রতিটি টাইলসের ওজন ২৮০-৩০০ গ্রামের মতো এবং এটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে যথাক্রমে ১১ ইঞ্চি ও সাড়ে ৭ ইঞ্চি।

তিনি জানান, ১ টুকরো টাইলস ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হতে পারে।

'এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি অন্য টাইলসের সঙ্গে সিমেন্ট বা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে আটকে রাখা যায়', যোগ করেন তিনি।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments