শিক্ষক থাকুক দুধে-ভাতে, বাঁচুক সম্মানে
ইতোমধ্যে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়েছেন, তাদের কাছে প্রিয় শিক্ষকের কথা জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশই স্কুলের শিক্ষকদের কথা বলেন।
যদি জিজ্ঞেস করা হয়, জীবনের কোন সময় ফিরে যেতে চান? অধিকাংশের কাছ থেকে উত্তর আসবে স্কুল জীবনে।
মানুষ নানাভাবে শিক্ষা গ্রহণ করে। কখনো সচেতনভাবে, কখনো অবচেতনে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে। আগুনের আঁচ সম্পর্কে শিক্ষা ছোট্ট শিশু অর্জন করে তার অভিজ্ঞতা থেকে। আক্ষরিকভাবেই মানবজীবনে অভিজ্ঞতাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
এভাবে আমৃত্যু মানুষ সমৃদ্ধ হয় নিত্য নতুন অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষায়। সেই অর্থে একজন মানুষ তার সমাজ ও পরিবেশের প্রভাবে আজীবন শিক্ষা লাভ করে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের শুরু হয় যাদের হাত ধরে, তারাই জীবনের প্রথম সারির শিক্ষক।
এই মানুষগুলো স্বপ্ন গড়ে দিতে জানেন। অন্য কোনো পেশায় এই পরিশীলিত মানব মনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ নেই বলেই এটি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এবং শ্রেষ্ঠ পেশা বলেই বিবেচিত।
শৈশব ও কৈশোরের মনস্তাত্ত্বিক এবং মানবীয় আচরণের হাল ধরেন স্কুল শিক্ষকরাই। ক্লাসভর্তি সহপাঠী। হুট করে শিক্ষক বললেন, এভাবে শব্দ করে হাঁটবে না। আবার বের হও! বের হয়ে আবার অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলেন। তবে এবার সন্তর্পণে ফেলা হলো সাবধানী পা। এভাবে একদিন দুদিন, এরপর চাইলেও জোরে শব্দ করে হাঁটার ইচ্ছেও হবে না।
খেয়াল করলে দেখবেন, আশপাশের অনেকের এই সৌজন্যতাবোধই নেই এবং জুতার শব্দে আপনিও বিরক্ত হচ্ছেন। অথচ এমন সুন্দর, শালীন, ভদ্রতা শিখিয়েছিলেন শিক্ষকরাই।
শুধু পাঠ্যবই পড়ানো নয়, তাদের হাত ধরেই গল্প বলার ঢং, বোঝানোর দক্ষতা, দৃঢ়তা আমাদের অবচেতন মন রপ্ত করে ফেলে। কাজী কাদের নওয়াজের লেখা শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতায় কবি দেখিয়েছেন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ঠিক কতটা মর্যাদার দাবিদার এই শিক্ষকরা।
শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকদের অসামান্য অবদান স্মরণ করার জন্য পালন করা হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবস পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (১৯৯৩ সালে গঠিত বেলজিয়ামভিত্তিক একটি শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্থা) ও এর সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে।
এসব সংগঠনের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় ও ইউনেস্কো-আইএলওর সদিচ্ছায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা বিষয়ক সনদ ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ-১৯৬৬ প্রণীত হয়।
১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে সংস্থার তৎকালীন এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের মহাপরিচালক ফ্রেডারিক মেয়রের অনুরোধে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল প্রতি বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য 'শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় শিক্ষকদের দিয়ে'। অন্য কথায়, শিক্ষকদের দিয়েই শিক্ষার পরিবর্তন শুরু।
জাপানি একটি প্রবাদ আছে, 'একজন মহান শিক্ষকের সঙ্গে একটি দিন হাজার দিনের আনন্দদায়ক অধ্যয়নের চেয়ে উত্তম।' অর্থাৎ ১ হাজার দিনের পরিশ্রমী অধ্যয়নের চেয়ে একদিন একজন শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করা অধিক ভালো। কারণ এর প্রভাব অসীম ও সুদূরপ্রসারী।
কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীকে অধ্যবসায়ী হওয়ার শিক্ষা দিলে সেই শিক্ষার্থী এক জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা ব্যবহার করে এগিয়ে যেতেই পারেন। হেনরি এডামস যথার্থই বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলে, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়।
শিক্ষকদের নৈতিকতা, সদাচরণসহ অনেক জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা বড় হওয়ার পর আমাদের যাপিত জীবনের ভুল কমিয়ে দেয়, বিড়ম্বনা কমিয়ে দেয়। যিনি খুব হেসে আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাশ-ফেলের দ্বন্দ্বে হতাশ কোনো শিক্ষার্থীকে বলেন, 'ব্যাপার না, তুমি ভালো করবে'। এই বোধ কোনো শিক্ষার্থীকে কতদূর এগিয়ে দেয়, সেটা শিক্ষার্থী মাত্রই স্বীকার করবেন। একটু প্রশংসা, একটু সুন্দর কথা দিয়ে তারা যেন জয় করে নেন মনন, আসে জীবনের গতিশীলতা। তখন প্রতিটি নিষ্পাপ মন এমনো ভেবে নেয়, বড় হয়ে এই শিক্ষকের মতোই হবো।
লেখক কাহলিল জিবরানের বলেছিলেন, 'একজন শিক্ষকের প্রচেষ্টাই কেবলমাত্র একজন দুর্বল শিক্ষার্থীকে সবল করে সফলতার শিখতে পৌঁছে দিতে পারে।'
একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে উৎসাহিত করেন।
বারাক ওবামার বলেছিলেন, 'যদি তুমি জীবনে সাফল্য অর্জন করে থাকো, তাহলে মনে রাখবে তোমার পাশে একজন শিক্ষক ছিল যে তোমাকে সাহায্য করেছিল।' যে কোনো পেশাদার খেলোয়াড়, সফল ব্যবসায়ী কিংবা ডাক্তার যাকেই আপনি জীবন নিয়ে, পেশা নিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, তিনি তার বক্তব্যের কোথাও না কোথাও তার শিক্ষকের কোনো বাণী শোনাবেন, যা তার চিন্তার জগতকে প্রভাবিত করেছিল।
শিক্ষক মানেই যেন ধৈর্য, সমতা, ইতিবাচক চিন্তার সমাহার। মহান শিক্ষকদেরই স্বতঃস্ফূর্ততা, বিজ্ঞানমনষ্ক যুক্তিবাদী জিজ্ঞাসায়, মুক্তচিন্তায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হয় মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, সহিষ্ণু ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে। শিক্ষকদেরও নিজেদের নিয়মিত পরিশীলিত করতে হয় বুদ্ধি ও যুক্তির আলোকে। শিক্ষা হোক আনন্দের, আমাদের সত্যিকার শিক্ষকেরা থাকুক দুধে-ভাতে, বাঁচুক সম্মানে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই হোক আমাদের প্রত্যয়। আর আলোকিত মানুষ হওয়ার তাগিদ বুনে দেওয়া সব শিক্ষককে বিশ্ব শিক্ষক দিবসে অকৃত্রিম শুভেচ্ছা।
Comments