গণঅভ্যুত্থান

আশা-নিরাশার আলো-আঁধার

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান, ছবি: সংগৃহীত

কোটা ও মেধার দ্বন্দ্ব থেকে সূত্রপাত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহসাই রূপ পায় গণঅভ্যুত্থানে। ক্রমান্বয়ে কোটা সুবিধার পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে।

মুক্তিযোদ্ধা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান পর্যন্ত কোটার আওতা সম্প্রসারণ হলে ক্ষোভাক্রান্তরা তাদের অশ্রু ও আর্তনাদকে তখনো প্রকাশ করেনি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ ও আত্মাহুতির প্রতি সবার সম্মান ছিল। ৪০ বছর পরে ২০১১ সালে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের পর্যন্ত এই সুবিধা সম্প্রসারিত হলো, তখন তাদের সঞ্চারিত ক্ষোভ দ্রুতই প্রকাশ পেতে শুরু করে। কোটাপদ্ধতির সংস্কার চেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নামে ২০১৮ সালে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বেগবান করতে বিভিন্ন পেশাজীবীও ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত ১৯৯৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেনি কোটাপদ্ধতির কারণে, তারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করেছে ও সমর্থন জুগিয়েছে আন্দোলনকারীদের পক্ষে।

২০১৮ সালের সেই আন্দোলন সবার সহযোগিতায় সফল হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির তথা ১ম থেকে ১৩তম গ্রেডের সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু, ২০২৪ সালে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় আবার শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন; যা সহসাই পুরো দেশে গণবিস্ফোরণ ঘটায়।

কোনো ছাত্র আন্দোলন কিংবা একঝাঁক শিক্ষার্থীর দাবি-দাওয়া কখন পুরো দেশবাসীর সমর্থন পায়? পুরো দেশের মানুষ কখন উচ্চ আদালত ও একটি সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়? কখন একটি সুসংগঠিত, সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুস্থাপিত জগদ্দল সরকার গণরোষে মাত্র ৩৬ দিনে সমূলে উৎপাটিত হয় এবং সেই সরকার প্রধানকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়? নিশ্চয়ই শুধুমাত্র একটি দাবি আদায়ের জন্য সহস্রাধিক শিশু-কিশোর-যুবক-জনতা তাদের জীবন উৎসর্গ করেননি। বহুমাত্রিক দাবি-দাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বহুরকম বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হওয়া অধিকার হারা গণমানুষের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ-স্পৃহা যুক্ত হয়েছিল চব্বিশের সেই আন্দোলনে, এই অভ্যুত্থানে।

৩৬ জুলাই তথা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জগদ্দল ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে আনন্দ, বিস্ময় ও অশ্রুপাতের পাশাপাশি ভয়, সংশয় ও উৎকণ্ঠাও সৃষ্টি হয়েছে সচেতন জনমনে।

আবেগী জাতি বাঙালি। তার আবেগের কতো ঘনত্ব, কতো পুরুত্ব, কতো বৈচিত্র্য। তাদের স্বপ্নের শেষ নেই। স্বপ্ন তো স্বপ্নই, আবেগ যে আবেগেই; জীবন-বাস্তবতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আবেগ স্বপ্ন কতোটা গুরুত্ব পায়? ২০০ কিংবা দুই হাজার বছরের মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়, তাতে জীবন বৃত্তাবদ্ধই এবং বৃত্তাবদ্ধ জীবনচক্র একই পরিণতির দিকে অগ্রসরমান।

জন্ম-বিকাশ-মৃত্যু এবং পুনরায় জন্ম-বিকাশ-মৃত্যু। কিংবা, আকাঙ্ক্ষা-অর্জন-অপমৃত্যু এবং আবারও আকাঙ্ক্ষা-অর্জন-অপমৃত্যু। স্বপ্ন-সংগ্রাম-সাফল্যের পর স্বপ্নভঙ্গ-ছিনতাই-ব্যর্থ শব্দগুলো চলে আসে বা ব্যবহৃত হয়েছে চিরকালই। পৃথিবীর কোন আন্দোলন-অভ্যুত্থান রাতারাতি সফল ও টেকসই হয়? সফল ও টেকসইয়ের জন্য সুদীর্ঘ সময় ও আন্তরিক অনুশীলন প্রয়োজন। বাস্তবিক অর্থে আমরা কতোটা সুশীল-মানবিক-শিক্ষিত? সহসাই আমাদের মুক্তি আসবে কীভাবে?

আমরা কি অন্তর্বর্তী সরকারকে মসৃণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দিচ্ছি? এই সরকার কি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গুণগতমানের বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন আনতে পারলো? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা কি আন্দোলন শেষে শ্রেণিকক্ষে কিংবা পড়ার টেবিলে ফিরেছে? সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো কি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পেরেছে? ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখা আমলারা কি এখনো অভিযুক্ত হয়েছে? আমলাতন্ত্রের অসারতা ও জটিলতা থেকে দেশ কি অবমুক্তির সম্ভাবনা দেখছে? পদ-পদবিধারী মানুষগুলোও একই এবং কিছুক্ষেত্রে মানুষ আলাদা হলেও মানসিকতা অপরিবর্তিত।

এতে করে একদল চাইবে, আরেক দল চাইবে না; একদল খেয়েছে, আরেক দল খাচ্ছে, আর একদল খাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত —এটাই স্বাভাবিক। স্বার্থের জন্য মব জাস্টিস হবে, চাঁদাবাজির জন্য খুনোখুনি হবে, প্রতারণার জন্য মিথ্যাচার হবে, দুর্নীতির জন্য বড় বড় প্রকল্পের অনুমোদন হবে, তথাকথিত উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো-ইমারত-স্থাপনা প্রতিনিয়তই ভাঙা-গড়া হবে, ধর্মের নামে অধর্ম হবে—এটাই স্বাভাবিক। মানবাধিকার, গুণগত পরিবর্তন, টেকসই জীবনমান, অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক ভারসাম্য, স্বাধীন আইন ও বিচারব্যবস্থা, উন্নত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনপদ্ধতি, গণতন্ত্র সবই কথার কথা—সবটাই শ্রুতিমধুর ও স্বাপ্নিক শব্দগুচ্ছ মাত্র।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে আস্থা ও মান্যতার যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। একুশ-একাত্তর-নব্বইয়ের সঙ্গে চব্বিশের পার্থক্য এ ক্ষেত্রে বিস্তর। পূর্বে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যূথবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের নেতৃত্ব ও নির্দেশনা পেয়েছে। কিন্তু এবার শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তারা মহাত্মন শামসুজ্জোহা ও মুনীর চৌধুরীদের অভিভাবকত্ব পায়নি। এমনকি অনেক অনেক সহানুভূতিশীল ও সক্রিয় শিক্ষকদের অবদানকেও তারা অস্বীকার করেছে অথবা করছে কিংবা করতে চাইছে। জুলাই আন্দোলনের সব অর্জন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদেরই এবং প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের সব নিয়ন্ত্রণের দাবিদার শুধু তারাই হবে—এমনটাই তাদের আকাঙ্ক্ষা ও অভিব্যক্তি।

অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদেরকেও শুনতে হচ্ছে বিরূপ মন্তব্য। পূর্বতন ফ্যাসিস্ট সরকার একাত্তরের চেতনা ফেরি করতো, কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধকে সম্মুখে এনে 'রাজাকার' বানাতো প্রতিপক্ষ ও প্রতিবাদীদের। আর, এখন ফেরি করা হচ্ছে চব্বিশকে! জুলাই আন্দোলনের চেতনার কথা বলে কথায় কথায় 'ফ্যাসিস্টের দোসর' বানানো হচ্ছে নিজ মতের সঙ্গে না মেলা ভিন্ন মতাবলম্বীদের!

মসনদ বিষয়ে রাজনীতিকরা রাজনীতির চরিত্র-চারিত্র্যেই অগ্রসর হবেন। ব্যবসায়ীরা সব ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক বাণিজ্য করবেন। আমলা ও ঠিকাদার শ্রেণি কাগজাদি ঠিক রেখে লাভের অংক সবসময়ই সুনিশ্চিত রাখবেন। অনুরূপ জীবনযুদ্ধের প্রশ্নে ও দৈনন্দিনের প্রয়োজনে নিম্নবৃত্ত ও মধ্যবৃত্ত হীন-দীন-সাধারণ মানুষের পেরেশানি চিরদিনই থাকবে। এভাবে সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রও একরূপ চলবে।

কিন্তু, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সৃষ্ট পারস্পরিক দূরত্ব যদি বেড়ে যায়, বাড়তেই থাকে, দ্রুতই কমে না আসে; শ্রেণিকক্ষ আর গবেষণাগার যদি শিক্ষার্থীদের কাছে সুখকর হয়ে না ওঠে; শিক্ষকরা যদি শিক্ষা ও গবেষণা উপেক্ষা করে পূর্বের মতো লেজুরবৃত্তি রাজনীতি করতে চায়; তারা যদি শিক্ষাবান্ধব না হয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক হতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে; সরকার যদি পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক আমূল পরিবর্তন আনতে গড়িমসি করে, উদ্যোগী না হয়, শিক্ষকতাকে মর্যাদাপূর্ণ করতে না চায়; তাহলে এই দেশের এই সমাজের মুক্তি নেই।

তখন নির্বাণের পথ হারিয়ে ব্যর্থ হবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। তখন আর এক নতুন ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর জন্য আবারও সূচনা করতে হবে নতুন আয়োজন। তখন বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা করতে হবে আরও বহু-বহুকাল।

Comments

The Daily Star  | English

Political clashes, mob attacks leave 25 dead in July 2025: MSF

The report, based on news from 18 media outlets and verified by rights activists, also noted an alarming rise in mob attacks, recording 51 incidents last month

43m ago