যেভাবে শুরু হয় লিপস্টিকের ব্যবহার

সাজসজ্জার ক্ষেত্রে লিপস্টিকের জনপ্রিয়তা সবসময়ই আকাশচুম্বী। ঠোঁট রাঙ্গাতে সাধারণত নারীরাই লিপস্টিক ব্যবহার করে থাকেন। তবে সময়ের বিবর্তনে এবং কিছু কিছু সমাজে পুরুষদের মধ্যেও লিপস্টিক ব্যবহারের প্রচলন আছে। শুধু সৌন্দর্যবর্ধন নয়, ব্যক্তিত্বের বিকাশেও ভূমিকা রাখে লিপস্টিক।
ছবি: সংগৃহীত

সাজসজ্জার ক্ষেত্রে লিপস্টিকের জনপ্রিয়তা সবসময়ই আকাশচুম্বী। ঠোঁট রাঙ্গাতে সাধারণত নারীরাই লিপস্টিক ব্যবহার করে থাকেন। তবে সময়ের বিবর্তনে এবং কিছু কিছু সমাজে পুরুষদের মধ্যেও লিপস্টিক ব্যবহারের প্রচলন আছে। শুধু সৌন্দর্যবর্ধন নয়, ব্যক্তিত্বের বিকাশেও ভূমিকা রাখে লিপস্টিক।

উৎসব-পার্বণ ছাড়াও অনেকে বাড়ির বাইরে যেতেও ঠোঁটে লিপস্টিকের হালকা আভা ছড়িয়ে দিতে ভালবাসেন। ১৯৩০ সালে আমেরিকান অভিনেত্রী ইভ আর্ডেন দাবি করেন, 'যেসব নারীরা লিপস্টিক ব্যবহারে করেন, তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।'

ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘকাল থেকেই লিপস্টিকের ব্যবহার করে আসছেন নারীরা। তবে তখনকার দিনে ফল ও গাছের রস থেকে তৈরি রং ব্যবহার করা হতো সাজসজ্জায়। সুমেরীয় সভ্যতা থেকে মিশরীয় সভ্যতা, এরপর রোমান সভ্যতা- নারী এবং পুরুষ উভয়ই ঠোঁট রাঙাতে ব্যবহার করেছে বেরি বা জাম জাতীয় ফল, পান পাতা, লাল সীসা, মাটি, মেহেদি, বিভিন্ন পোকামাকড়, গাছ-গাছড়া কিংবা বিভিন্ন খনিজ। তবে সেসব উপাদান ব্যবহার করা হতো আঠার সাহায্যে। যেন তা ঠোঁটে লেগে থাকে।

এরপর উচ্চবিত্ত মেসোপটেমিয়ানরা ঠোঁট রাঙ্গাতে রত্নচূর্ণ ব্যবহার করতো। মিশরীয়রা রঞ্জক পদার্থ যেমন অ্যালজিন, আয়োডিন ও ব্রোমিনের মিশ্রণে লাল রঙ তৈরি করে লিপস্টিক ব্যবহার করত। ফারাও রাণী ক্লিওপেট্রা গাঢ় লাল রঙ ব্যবহার করতেন ঠোঁটে।

ছবি: সংগৃহীত

লিপস্টিক নামের প্রচলন হয়েছে ১৮৮০ সালে। সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক লিপস্টিক উৎপাদনে ফ্রান্সের নাম উঠে আসে। ১৮৮০ সালে প্যারিসে সুগন্ধি শিল্পেই তৈরি হয় বাণিজ্যিক লিপস্টিক। ১৮৯০ সালের শেষদিকে ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে লিপস্টিক বিক্রি করা শুরু হয় এবং এর প্রসারে বিজ্ঞাপন প্রচারও শুরু হয়। সেসময়  লিপস্টিক কাগজের কৌটায় বা টিউবে বিক্রি করা হতো। ১৯১৫ সালে মরিস লেভি সর্বপ্রথম ধাতব কৌটার লিপস্টিক তৈরি করলেন যা ঠেলে উপরে তোলা যায়। তারই হাত ধরে আধুনিক লিপস্টিকের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়। লিপস্টিকটি ছিল সহজে বহনযোগ্য এবং সাধারণ নারীদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে।

যা আমরা আজ 'আধুনিক লিপস্টিক' বলে জানি তার নাম 'সুইভেল-আপ' লিপস্টিক। এটি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন হয় ১৯২৩ সালে। এই লিপস্টিকের উদ্ভাবক জেমস ব্রুস জুনিয়র এটিকে বলেছিলেন 'টয়লেট আর্টিকেল'।

ছবি: সংগৃহীত

যুগে যুগে লিপস্টিকের সঙ্গে সমাজ বাস্তবতা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ধর্ম জড়িয়ে গেলেও লিপস্টিকের জনপ্রিয়তা কমেনি একটুও। তারই ধারাবাহিকতায় লিপস্টিকের রঙেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

চলুন দেখে নেওয়া যাক কোন রঙের লিপস্টিক কী অর্থ বহন করে।

ছবি: সংগৃহীত

লাল রঙ

লাল লিপস্টিকের আবেদন কখনোই পুরোনো হয় না৷ ষোড়শ শতাব্দীতে রানী প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন প্রসাধনীর প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট। তিনি সাধারণত ঠোঁটে লাল রঙ ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। লাল লিপস্টিক যদি কারো প্রিয় হয়ে থাকে তবে তিনি সাহসী তো বটেই, সেই সঙ্গে তাকে খুবই আত্মবিশ্বাসী এবং শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে মনে করা হয়। ধারণা করা হয়, এরা খুব আনন্দ প্রিয়, আত্মসচেতন এবং কাজের ক্ষেত্রে মনযোগী হয়ে থাকে। রেড কালারের লিপস্টিক পছন্দকারী নারীরা অত্যধিক সামাজিকও হয়ে থাকে।

ছবি: সংগৃহীত

গোলাপি রঙ

মধ্যযুগে লিপস্টিকের সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে যায়। খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের পর লাল লিপস্টিক পরাকে শয়তানের কাজের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হতো। প্রসাধনী নিষিদ্ধ করার জন্য তৎকালীন সময় পোপ একটি নির্দেশনা প্রচলন করেন। তবে এর ফলশ্রুতিতে লিপস্টিক পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। কিন্তু তখন লাল বা গাঢ় রঙের পরিবর্তে জায়গা করে নিলো প্রাকৃতিক গোলাপি রঙ। যা নারীদের পাপশূন্যতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল।

ছবি: সংগৃহীত

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেসব নারী গোলাপি রঙের লিপস্টিক পছন্দ করেন, তারা কোমল মনের হয়ে থাকে। পিঙ্ক কালারের লিপস্টিক ব্যবহারকারী নারীরা দয়ালু এবং যত্নশীল বলে পরিচিত। তারা সাধারণত চমৎকার, মিষ্টভাষী, নিরপরাধ, নরম স্বভাবের হয়ে থাকে। মাঝেমাঝে কিছুটা সংবেদনশীলও।

ন্যুড শেড

ন্যুড শেডের লিপস্টিকের জনপ্রিয়তা বেশ কয়েক বছর ধরেই অনেক বেশি। যারা ন্যুড শেড পরতে পছন্দ করেন তারা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় বলে মনে করা হয়৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা নিজেদের সৌন্দর্য নিয়েও অত্যন্ত সচেতন।

ব্রাউন শেড

সমাজের উলটো স্রোতে যারা হাঁটতে চান তারা না কি ব্রাউন শেডের লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙাতে বেশি ভালবাসেন৷ যেকোনো বিষয়ে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহসিকতাও বেশি থাকে তাদের৷ ৯০ এর দশকে পরিবেশবাদী চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটার ফলে মানুষ তাদের আশেপাশে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ চাওয়ার পাশাপাশি তাদের সাজগোজেও চেয়েছিল প্রকৃতির ছোঁয়া। তাই নারীরা ঝুঁকে গেলো আর্থ-টোনের লিপস্টিক অর্থাৎ ব্রাউন কালারের দিকে। সে সময় থেকেই ব্রাউন শেডের লিপস্টিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নারীদের কাছে।

পিচ শেড

পিচ শেডের লিপস্টিক ব্যবহার শুধু অফিশিয়াল কাজেকর্মে নয় বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানেও করতে দেখা যায়। পিচ কালারের লিপস্টিক ব্যবহারকারীরা সাধারণত ভদ্র এবং আশাবাদী স্বভাবের হয়ে থাকে। তারা সব সময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে।

কমলা শেড

অরেঞ্জ বা কমলা শেডের লিপস্টিক ব্যক্তির মনের আনন্দকে প্রকাশ করে। সাধারণত যারা একটু আমুদে ও উচ্ছল স্বভাবের তারাই ঠোঁট রাঙ্গাতে কমলাকে বেছে নেন।

ইউনিক শেড

ইউনিক শেড বলতে বোঝানো হয়, যে শেডের ব্যবহার সচরাচর দেখা যায় না, তবে ব্যবহার রয়েছে। কালো, সাদা, সবুজ, বেগুনি যেকোনো রঙই হতে পারে ইউনিক শেড।

'পাংক আদিবাসী সংস্কৃতি' প্রাকৃতিক ধরনের সাজের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধনের বিরোধিতা করে এক নতুন বাঁকের জন্ম দিয়েছে। যা ভেঙে দেয় সৌন্দর্যের ব্যাপারে পশ্চিমা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে। এর ফলে ঠোঁটের সাজে উঠে আসে সাদা, ধূসর, কালো এবং বেগুনি রঙের ব্যবহার। তবে এসব রঙের ব্যবহারের উদ্দীপনার জন্ম নেয় কম বাজেটের বাণিজ্যিক হরর মুভিগুলো থেকে।

তাই ইউনিক শেডের লিপস্টিক যারা ব্যবহার করেন তাদের ধরা হয় প্রথাবিরোধী। যারা সমাজের প্রচলিত নিয়মনীতি তোয়াক্কা করে না। তারা সাহসী আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তবে অনেকে তাদের হতাশাগ্রস্ত বা জীবনবিমুখ বলেও মনে করে থাকে।

লিপস্টিকের ধরন

লিপস্টিক সাধারণত দুই ধরনের হয়, গ্লসি ও ম্যাট।

গ্লসি

১৯৩০ সালে ম্যাক্স ফ্যাক্টর সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক লিপগ্লস তৈরি করে যা তৎকালীন সময়ের চলচ্চিত্র তারকারা ব্যবহার করতেন। প্রকৃতপক্ষে এটি তখন হয়ে যায় হলিউডের গ্ল্যামার আর সিনেমার স্বর্ণযুগের প্রতীক। ত্রিশের দশকে হলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তুঙ্গে থাকা লিপগ্লস চলে আসলো সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। সেই থেকে এটি হয়ে গেলো তারুণ্যদীপ্ত আনন্দের প্রতীক। যেসব নারীরা চিরযৌবনা ও সতেজ থাকতে ভালবাসে তারাই গ্লসি লিপস্টিক ব্যবহার করে থাকেন।

ম্যাট

সাধারণত ঠোঁটের সঙ্গে মিশে থাকা লিপস্টিকগুলোই ম্যাট লিপস্টিক। এগুলো ঠোঁটে চকচকে ভাব আনে না। তবে সৌন্দর্য বর্ধন করে ঠিকই। বর্তমানে ম্যাট লিপস্টিকের জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হয়, যেসব নারীরা ম্যাট পড়তে পছন্দ করেন, তারা বাস্তববাদী হয়ে থাকে। তাদের আত্মসম্মানবোধও বেশি।

সূত্র:

১. দ্য গার্ডিয়ান

২. টাইমস অব ইন্ডিয়া

Comments