দীর্ঘায়িত হচ্ছে বন্যা, ত্রাণের জন্য বাড়ছে হাহাকার

শুক্রবার সিলেট ও সুনামগঞ্জে নদীর পানি কিছুটা কমলেও বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার বাড়ছে।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রাধানগরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি-ঘর বন্যার পানিতে প্রায় তলিয়ে গেছে। আশেপাশের আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা না থাকায় অনেক বাসিন্দা তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আকস্মিক বন্যায় সিলেট ও​সুনামগঞ্জে প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবিটি গতকাল তোলা। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

শুক্রবার সিলেট ও সুনামগঞ্জে নদীর পানি কিছুটা কমলেও বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার বাড়ছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ত্রাণ বরাদ্দ পর্যাপ্ত এবং অব্যাহত আছে। কিন্তু, ধাপে ধাপে সংশ্লিষ্টদের হাত পেরিয়ে তা সময়মতো বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। ফলে, দুর্গতদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি বাড়ছে।

আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করছেন এক নারী। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নরসিংপুর গ্রামের সাজ্জাদ মিয়া বলেন, 'গত ৩ দিন ধরে আমরা জলাবদ্ধ। যখনই আমাদের গ্রামের কাছে কোনো নৌকা আসতে দেখি, আমরা ত্রাণের আশায় ছুটে যাই। কিন্তু, এখনো আমাদের জন্য কোনো সরকারি ত্রাণ আসেনি।'

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লালপুর গ্রামের বাসিন্দা জসীম মিয়া বলেন, 'সুরমা নদীর পানি উপচে আমাদের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। আমরা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছি। কিন্তু, এখনো কোনো সহায়তা পাইনি।'

পর্যাপ্ত ত্রাণ ইউনিয়ন পর্যায়ে আসছে না জানিয়ে দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস শহীদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষদের সহায়তা দেওয়ার পর খুব বেশি ত্রাণ থাকছে না। ফলে, বন্যাকবলিত সবাইকে সাহায্য করা সম্ভব হচ্ছে না। আরও ত্রাণ সহায়তা চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।'

আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যাদুর্গতরা। তারা যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে নৌকা ব্যবহার করছেন। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত উপজেলায় মোট ১৪০ টন চাল, ২ হাজার বস্তা শুকনো খাবার এবং নগদ ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সময় জেলার বন্যা আক্রান্ত ৫টি উপজেলায় ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক'শ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে বরাদ্দ করা ত্রাণ পাঠাই। পরে তারা তা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করেন। তারপর চেয়ারম্যান থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'সংশ্লিষ্ট সবাই কঠিন পরিশ্রম করছেন। সবার কাছেই ত্রাণ পৌঁছাবে, কোথাও একটু আগে বা একটু পরে।'

একই চিত্র সিলেট জেলায়। এ জেলার ১৩টি উপজেলার সবকটি এলাকা কম-বেশি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বন্যাকবলিত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ত্রাণ থেকে এখনো বঞ্চিত আছেন।

সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলায় মোট ৩০৫ টন চাল, ৩ হাজার ২০৫ বস্তা শুকনো খাবার এবং ১৫ নগদ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং বন্যাকবলিত সবাই দ্রুত ত্রাণ সহায়তা পাবেন।'

এখনো অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ পৌঁছায়নি। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি মন্ত্রণালয় আছে এবং তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাও থাকে। কিন্তু, আমরা আগেও লক্ষ্য করেছি যে দুর্নীতি এ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে, মানুষ প্রয়োজনীয় ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়।'

তিনি বলেন, 'ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতার স্বার্থেই প্রতিটা উপজেলায় সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত ত্রাণ কমিটি থাকা উচিত। একইসঙ্গে বন্যা আক্রান্ত এলাকাগুলোকে 'দুর্গত' হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছি।'

শুক্রবার বিকেল ৩টার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) নদীর পানির উচ্চতা সম্পর্কিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি কিছুটা কমেছে।

এসময় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যা গতকালের চেয়ে ২১ সেন্টিমিটার কম।

খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন বন্যাকবলিতরা। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

একই সময়ে সুরমা নদী সুনামগঞ্জ শহর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপরে (বৃহস্পতিবারের চেয়ে ৯ সে.মি. কম) এবং সিলেট সিটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩২ সে.মি. ওপরে (বৃহস্পতিবারের চেয়ে ১৫ সে.মি. কম) প্রবাহিত হচ্ছে।

কুশিয়ারা নদীর পানি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশীদ এলাকায় বিপৎসীমার ১৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা আগের দিনের চেয়ে ৮ সেন্টিমিটার কম।

তবে এ নদীর পানি বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলা পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এফএফডব্লিউসি প্রতিবেদন অনুযায়ী, শনিবার সকাল পর্যন্ত সিলেট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও হবিগঞ্জের আরও কয়েকটি নদীর পানি এই সময়ের মধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

শুক্রবার খোয়াই নদী হবিগঞ্জের বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার মাত্র ৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, পুরাতন সুরমা নদী সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় বিপৎসীমার বরাবর এবং নেত্রকোনার কলমাকান্দায় সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

Comments