অস্বস্তির বাজেট চেপে ধরার বাজেট
যখন ভরসার প্রয়োজন ছিল, তখন তিনি ভয় পাইয়ে দিলেন।
জীবনযাত্রার সংকট, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার চতুর্থ বাজেট বক্তৃতায় যা বললেন তার মূল বক্তব্য হলো, বেশিরভাগ মানুষের জন্য সামনে আর ভালো দিন নেই।
তিনি তার বাজেট বক্তৃতায় ২৯ বার মূল্যস্ফীতির কথা উল্লেখ করেছেন। এতে বোঝা যায় তিনি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টেনে ধরতে হিমশিম খাচ্ছেন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব। অর্থাৎ এটি ঠেকাতে সরকার খুব বেশি কিছু করতে পারে না।
সরকারের হাতে যা থাকে তা হচ্ছে অর্থ ও অর্থনৈতিক কৌশল এবং আকাঙ্ক্ষা যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা থেকে জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
সমাজের ধনী শ্রেণির থেকে দরিদ্রদের মধ্যে কিছু অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থা করার সুযোগ ছিল অর্থমন্ত্রীর কাছে।
কিন্তু, তিনি তা করেননি।
ব্যাংকে ৫ কোটি বা তার বেশি টাকা থাকলে এর ওপর আবগারি শুল্ক মাত্র ১০ হাজার টাকা বাড়িয়েছেন তিনি।
এদিকে, বাজেটে স্বর্ণের মতো বিলাসবহুল দ্রব্য আমদানির ওপর অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার আমদানিতে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী ল্যাপটপ, লিফট, মোবাইল ব্যাটারি, চার্জার ও ইন্টারেক্টিভ ডিসপ্লের মতো কিছু পণ্যের স্থানীয় উত্পাদনকে উত্সাহিত করতে চেয়েছেন।
তিনি সে সব পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক কমিয়েছেন।
কাগজে-কলমে এ সিদ্ধান্তটিকে বেশ আশাব্যঞ্জক মনে হলেও, বাস্তবে নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীই এই সুবিধা পাবে।
অথচ বাজেটে দরিদ্র ও অসহায়দের কোনো স্বস্তির খবর নেই।
দরিদ্র ও দুস্থদের জীবনযাত্রার চলমান সংকটের মধ্যে ব্যয় নির্বাহের সুবিধার্থে আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া পরবর্তী অর্থবছরের হিসেবে কোনও নগদ সহায়তা নেই।
এ ক্ষেত্রে আগের বিদায়ী অর্থবছরের মতো এবারও শুধু ৫ হাজার কোটি টাকা আলাদা রাখা হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষকে এককালীন আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
যারা এখনো মহামারির ধাক্কা সামলাতে পারেননি, তাদের জন্য এটি খুব একটা সহায়ক হবে না। কারণ, লাখের বেশি মানুষের এই সহায়তা প্রয়োজন এবং তাদের প্রতি মাসেই এটি প্রয়োজন।
দেশের প্রায় ৪ কোটি মধ্যবিত্তের জন্যও রাখা হয়নি তেমন কোনো সুবিধা।
মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করে করমুক্ত আয় সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়ানো হয়নি। ব্যাংকে তাদের উপযোগী সঞ্চয়ের ওপর আবগারি শুল্কও কমানো হয়নি।
এটি বিশেষ করে পেনশনভোগীদের জন্য একটি বড় ধাক্কা। মূল্যস্ফীতির এই সময় এসে তাদের সঞ্চয়ের মূল্যমান নিশ্চিতভাবে কমে গেছে এবং সুদের হারের সীমার পরিপ্রেক্ষিতে তা সমন্বয়ও সম্ভব নয়।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে তিনি নৈতিকভাবে বা রাজনৈতিকভাবে যে কারণেই এসব প্রস্তাব করেন না কেন, এই সুযোগ তিনি পান সীমিত অর্থনৈতিক পরিসরের কারণে।
কিন্তু, গতানুগতিক ধারার বাইরে কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি উত্তরণের উপায় খুঁজতে পারতেন।
অর্থমন্ত্রী বাজেটে ভর্তুকি হিসেবে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন, যেন ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম খুব বেশি না বাড়ে। কিন্তু, এই ভর্তুকি যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এই অর্থ সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ দিলে, তার ভালো ব্যবহার হতো।
সংক্ষেপে, জনগণের খরচযোগ্য আয় আরও সংকুচিত হবে।
এমন নয় যে এই জনগোষ্ঠীর জন্য স্বস্তিদায়ক কোনো প্রস্তাব রাখার সুযোগ তার ছিল না।
সরকারি চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনার একেবারেই প্রয়োজন ছিল না। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলারের বিনিময় হারকে ভারসাম্য করার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
একই কারণে রপ্তানির জন্য নগদ প্রণোদনার আর প্রয়োজন নেই।
কৃচ্ছতা সরকার নিজের মধ্যেই শুরু করতে পারত। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ একই থাকতে পারত এবং ধীরগতিতে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আটকে রাখা যেত।
আমাদের মন্ত্রী যদি স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক সমাধান না দিতে পারেন, তিনি দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রণয়নেও যথোপযুক্ত নন।
তিনি ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হওয়ার প্রস্তুতির কথা বলেছেন, তবে এ বিষয়ে কোনো কৌশলের কথা উল্লেখ করেননি।
মন্ত্রী মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তৃতার বিষয়বস্তুগুলো ছিল প্রতিশ্রুতির, কিন্তু নির্দিষ্টতা ছিল খুব কম ক্ষেত্রেই।
তিনি মানবসম্পদের উন্নয়নকে তার ৬টি অগ্রাধিকার খাতের একটি বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ জিডিপি অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ করেছেন।
বিদায়ী অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২ দশমিক ০৮ শতাংশ, যা ইউনেস্কোর সুপারিশকৃত ৪-৬ শতাংশের চেয়ে অনেক কম।
মহামারির কারণে সৃষ্ট শিক্ষা ঘাটতি পুনরুদ্ধারে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য তরুণদের প্রস্তুত করার সময় যখন এল, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমাতে এলেন।
কৃষিখাতকে অর্থমন্ত্রী দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এ খাতকে উন্নত করতে ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের অংশ হিসেবে উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা তিনি বলেননি।
কৃষি সরঞ্জামের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করা হলেও, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে দরিদ্র কৃষকের জন্য কোনো নির্দিষ্ট প্রণোদনা নেই।
তিনি কৃষি খাতকে আরেকটি অগ্রাধিকার হিসাবে চিহ্নিত করেছেন এবং এখনও এর উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।
যখন খাদ্য নিরাপত্তাই নিশ্চিত হয় না, তখন কৃষি রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনার কোনো যুক্তি থাকে না বরং আমাদের অবাক করে।
এ সময়ে এসে সরকারের একটি কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা দেখানো দরকার ছিল। কিন্তু এ খাতেও বাজেট বরাদ্দ কমবেশি বিদায়ী বছরের মতোই রয়ে গেছে।
বাজেটে যে একেবারেই কোনো আশার আলো নেই, তা নয়।
সেচ পাম্পের জন্য বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ ছাড় এবং কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও থ্রেসারের জন্য রেয়াতযোগ্য আমদানি সুবিধা অবশ্য একটি সঠিক সিদ্ধান্ত।
প্রকল্প বাস্তবায়ন বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আর কর ছাড় না দেওয়ার প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো যেতে পারে। এটি রাজস্ব প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনবে এবং বাজেট ঘাটতি পরিচালনা করতে সহায়তা করবে।
অনেক ধরনের সেবা পেতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়োজন এবং সরকারের বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সত্যিই সাহসী পদক্ষেপ।
কাগজে কলমে সরকার অবশ্যই করের আওতা প্রসারিত করবে এবং কর সম্মতি উন্নত করবে। কিন্তু ট্যাক্স ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় না হওয়ায়, তার কতটা বাস্তব রূপ নেয় তা দেখার বিষয়।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেটের খসড়া প্রণয়ন করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সংকীর্ণ পরিসরের মুখোমুখি হয়েছেন এবং এটিকে বিস্তৃত করতে তিনি কোনো সাহসী পদক্ষেপ নেননি।
তিনি বিগত বছরগুলোর মতো অটোমেশনের কথা বলেছেন। কিন্তু সেখানেও এর পেছনে উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া তালিকাভুক্ত এবং তালিকা বহির্ভূত উভয় কোম্পানির জন্য করপোরেট কর কমানো এবং নিম্ন কর সীমা প্রসারিত করার সিদ্ধান্তটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
এই সুবিধা এতদিন পর্যন্ত শুধু পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য ছিল। এখন অন্যান্য রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোও এই সুবিধা পাবে। এতে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের আওতা বাড়বে বলে আশা করা যায়।
আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে এমন পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, যেহেতু এই শিল্প বাংলাদেশের জিডিপিতে অন্তত ২৫ শতাংশ অবদান রাখে এবং বেসরকারি খাতের ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
পয়ঃনিষ্কাশন প্ল্যান্টের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করায় আমাদের জলাশয় ও জলাভূমি দূষণের হাত থেকে বাঁচতে পারে, যা টেকসই পরিবেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
মোটরসাইকেলের আমদানির বিকল্প খোঁজা এবং স্টেইনলেস স্টিল শিটের আমদানি শুল্ক কমানোর মাধ্যমে দেশীয় স্টেইনলেস স্টিল পণ্য উৎপাদনকে উৎসাহিত করে 'মেড ইন বাংলাদেশ' এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে।
বিলাসবহুল মোটরযান, জিপ, ঝাড়বাতি ও বিলাসবহুল লাইট ফিটিংয়ের আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে মোট কর বৃদ্ধি করায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আরও অর্থ জমা হবে।
তবুও, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মনে সন্দেহ আছে যে পুরো কর ব্যবস্থা পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট হবে না।
তাই তিনি ২০১২ সাল থেকে অপরিবর্তিত থাকা স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন।
যা বলা হোক বা করা হোক, বাজেটে যা কিছু রাখা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়। কিন্তু প্রতিবছর এখানেই সরকার ব্যর্থ হয়। আশা করি পরের বছর হয়তো ভিন্ন হবে।
Comments