দেশে দেশে ‘শ্রীলঙ্কা সংকট’

চূড়ান্ত আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক দশকের মধ্যে দেশটিতে সবচেয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কলম্বোয় প্রেসিডেন্টশিয়াল সেক্রেটারিয়েট প্রাঙ্গণে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের জমায়েত। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

অর্থনৈতিক সংকট শুধু শ্রীলঙ্কাতেই সীমাবদ্ধ নেই। ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ একই সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছিলেন, সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তারা পদত্যাগ করবেন।

দ্বীপরাষ্ট্রটি স্বাধীনতার পর সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাওয়ায় গত শনিবার হাজারো বিক্ষোভকারী কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বিলাসবহুল বাসভবন দখল করে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠে।

প্রেসিডেন্ট ভবনের ভেতরে বিক্ষোভকারীদের ঢেউ। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনের বিছানায় শুয়ে আছেন, পুলে নেমে সাঁতার কাটছেন, রান্না করছেন, পিয়ানো বাজাচ্ছেন, কেরাম খেলছেন, খাবার খাচ্ছেন ইত্যাদি। এগুলোকে রাজনৈতিক অভিজাতদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার দৃশ্যপটও বলা যেতে পারে। গত শুক্রবার থেকে রাজাপাকসে ও বিক্রমাসিংহেকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।

শ্রীলঙ্কার গত মে ৮ জন নিহত ও ২০০ জনেরও বেশি আহত হন। সরকার সমর্থকদের হামলায় কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন। তার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকেন এবং রনিল বিক্রমাসিংহেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন।

প্রেসিডেন্ট ভবনে পিয়ানো বাজাচ্ছে ২ শিশু। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

তবে, নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে দিয়েও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং জ্বালানি আমদানিতে শ্রীলঙ্কার প্রয়োজনীয় ডলার প্রায় শেষ হয়ে যায়। পেট্রোল-ডিজেল ছাড়াও রান্নার গ্যাস কিনতে মানুষকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চরম ঘাটতির কারণে এই অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।

তবে শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ একই ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

লঙ্কা সংকট

অন্যান্য দেশের কথা উল্লেখ করার আগে শ্রীলঙ্কার সংকট নিয়ে একটু পেছনে ফেরা যাক। যেভাবে শ্রীলঙ্কা এমন ভয়াবহ সংকটে পড়ল তা একবার দেখে নেওয়া যাক। রাজাপাকসে পরিবারের প্রতি শ্রীলঙ্কার মানুষের অভিযোগগুলো হলো—নিপীড়ন, স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি। যদিও এই সংকটের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। চীনা ঋণের কারণে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করা শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত গত মে'তে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।

প্রেসিডেন্ট ভবনের সুইমিং পুল। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ইন্ডিয়া টুডে বলছে, শ্রীলঙ্কা বিদেশে পণ্য বিক্রি না করে দেশীয় বাজারের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। তাই দেশটির রপ্তানি আয় কমে যায় এবং আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে।

২০১৯ সালের এপ্রিলে ইস্টার সানডেতে সন্ত্রাসী হামলা শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পে মারাত্মক আঘাত হানে, যা দেশটির সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন খাতের একটি। এরপরই আমদানি-নির্ভর দেশটিতে পণ্য সংগ্রহে সংগ্রাম শুরু হয়।

প্রেসিডেন্ট ভবনের বাগানে বিক্ষোভকারী। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ব্যাপক কর হ্রাসের আদেশ দেন। এতে দীর্ঘস্থায়ী বাজেট ঘাটতিতে থাকা দেশটি বিশাল রাজস্ব হারায়।

এরপর আসে করোনা মহামারি। এটি পর্যটন খাতকে মোটামুটি পঙ্গু করে দেয়। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যায়। ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।

২০২১ সালে সরকার রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করে বৈদেশিক মুদ্রার বহির্গমন ঠেকানোর চেষ্টা করে। এর পরিবর্তে কৃষকদের জৈব সার ব্যবহার করতে বলা হয়। এর ফল হয় উল্টো। ফসলের উৎপাদন কমে যায়। কৃষিখাতেও অস্থিরতা নামে। বিদেশ থেকে খাদ্য কেনায় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আরও প্রকট হয়।

প্রেসিডেন্টের বিছানা। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

বিশ্লেষদের মতো, সমস্যাগুলো অনেকটা চক্রাকারের মতো। একটি দেশে যা ঘটে তা শুধু সে দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও বিদেশি ঋণে জর্জরিত অনেক দেশ একই রকম খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতির মুখোমুখি হচ্ছে।

পাকিস্তানে অস্থিরতা

উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। দেশটি সম্প্রতি ঋণ খেলাপি এড়ানোর চেষ্টা করছে। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি-আমদানি খরচ বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে। পাকিস্তানে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পতন বিশ্বের জন্য আরও চিন্তার কারণ হতে পারে। দেশটির এই সমস্যার পেছনে একাধিক কারণের মধ্যে রয়েছে—মৌলবাদ, পারমাণবিক অস্ত্র ও দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশী দেশে তালেবানের উপস্থিতি। শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে বেলআউট চেয়েছে।

ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত জুনে পাকিস্তানের এক মন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলেন। তিনি সুপারিশ করেছিলেন, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দেশের আমদানি খরচ কমাতে জনগণের প্রতিদিনের চায়ের খরচ কমাতে হবে। পাকিস্তানের বন্ধুপ্রতীম চীন ২৩০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আনতে পারবে না। এই ঋণও দেশটির সমস্যারও অংশ। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও এমনটাই দেখা গেছে।

চীনা ঋণ

ইন্ডিয়া টুডে বলছে, অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ বা ঋণ শ্রীলঙ্কার ওপর চীনের প্রভাব বাড়ায়। এই ঋণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনৈতিক সংকট প্রকট করে তোলে। শ্রীলঙ্কা বছরের পর বছর বাজেটের ঘাটতি পূরণে এবং অর্থনীতি সচল রাখতে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছিল।

ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ব্যয়বহুল ও অকার্যকর বিমান চলাচল, শিপিং, হাইওয়ে, পর্যটন এবং এ জাতীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে প্রচুর অর্থ অপচয় করেছে শ্রীলঙ্কা। এটি সে দেশের মানুষের ওপর ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কা প্রতিবেশী ভারত, জাপান ও চীনের সঙ্গে আলোচনা করছে। এমনকি যুদ্ধরত রাশিয়ার কাছেও সাহায্যের আবেদন করেছে। এখন পর্যন্ত ভারত শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সহায়তা দিয়েছে। যার মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময় এবং ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন আছে।

ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

অন্যান্য দেশ

শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, জাম্বিয়া ও অন্যান্যরাও ডিফল্ট হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ জাম্বিয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণে ৩৬০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের কথা বলা যেতে পারে।

জাম্বিয়ার মতো লেবাননে আর্থিক মন্দার কারণে ব্ল্যাকআউট ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তারা ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বিশ্বব্যাপী সহায়তা চেয়েছে।

এশিয়ার অপর দেশ লাওস ঋণের বোঝা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার দরপতন ও ডলার ঘাটতিতে ভুগছে। চীনের কাছ থেকে লাওস ১৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। এর বেশিরভাগই বড় আকারের অবকাঠামো নির্মাণে খরচ হয়েছে।

ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুসারে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং উচ্চ মার্কিন সুদের হার জ্বালানি ও অন্যান্য আমদানিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে। এটি অনেক দেশকে মুদ্রাস্ফীতির দিকে ধাবিত করছে। বিপুল পরিমাণ ঋণে জর্জরিত দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

ইউরোপে জার্মানি, গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগাল অস্থিরতা কমাতে কর ছাড় এবং বড় আকারের ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে। আফ্রিকায় নাইজেরিয়া ও জাম্বিয়াও একই কাজ করেছে।

এশিয়ায় ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া সামাজিক ব্যয় বাড়াচ্ছে এবং সরাসরি নগদ অর্থ দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ জাতীয় উদ্যোগ বিশৃঙ্খলা আরও বাড়াতে পারে।

যাই হোক, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে ঋণে জর্জরিত অনেক দেশ শ্রীলঙ্কার মতো একই ধরনের খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। পরবর্তীতে এই সংকট আরও প্রকট হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর করোনা মহামারির মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এটি এখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Tk 707cr spent in 9yrs, dengue still ravages Dhaka

This year, DNCC proposed Tk 135 crore budget and DSCC Tk 46.50 crore for mosquito-control activities.

10h ago