বহির্নোঙর থেকে ভোজ্যতেল পাচারের অভিযোগ আ. লীগ নেতার বিরুদ্ধে

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা তেলবাহী মাদার ভেসেল থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে বালুবাহী বার্জ দিয়ে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল পাচার করছে চট্টগ্রামের নগরীর ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকার একটি চক্র।
চট্টগ্রামে সদরঘাট নৌ পুলিশের থানার পেছনে জব্দ করে রাখা হয়েছে ভোজ্যতেল পাচারে ব্যবহার করা এমভি তানিশা। ছবি: স্টার

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা তেলবাহী মাদার ভেসেল থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে বালুবাহী বার্জ দিয়ে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল পাচার করছে চট্টগ্রামের নগরীর ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকার একটি চক্র।

অভিযোগ আছে, এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকার হারুনুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি। যিনি নিজেকে নগরীর ৩৯নং ইপিজেড ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে দাবি করেন।

স্থানীয় থানা পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীদের 'ম্যানেজ' করে কর্ণফুলী নদী দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হারুনের এই সিন্ডিকেট বহির্নোঙরে থাকা বিদেশি জাহাজে বিভিন্ন খাদ্য ও পণ্যদ্রব্য পৌঁছে দেয়ার আড়ালে ভোজ্যতেলসহ জ্বালানি তেল পাচার কারবার চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ আছে।

আর এই অপরিশোধিত ভোজ্যতেল স্থানীয় বাজারে এনে ড্রামে ভরে বিক্রি করে দেওয়া হয় খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন তেলের আড়তে। কম দামের এসব তেল বিক্রি হয় রাস্তার ধারের ফুটপাত ও কমদামের খাবারের দোকানে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

 অনেকটা আড়াল থেকে কার্যক্রম চালালেও চট্টগ্রাম নৌপুলিশ ১১ হাজার লিটারসহ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা থানাধীন ১৩নং ঘাটের উত্তর লালদিয়ার চর এলাকা থেকে 'এমভি তানিশা' নামের একটি লাইটারেজ জাহাজ আটক করলে বের হয়ে আসে তেলপাচারের ঘটনা। আটক করা হারুনের বড় ভাই হুমায়ুন কবিরসহ ১২ জনকে। জব্দ করা হয় জাহাজ থেকে তেল পাচারের জন্য নদীর পাড়ে এনে রাখা দুটি তেলের ভাউচার।

হারুনুর রশিদ। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনার পরদিন চট্টগ্রাম সদরঘাট নৌ থানার উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মিঠুন বালা বাদী হয়ে হারুনসহ ১৪ জনকে আসামি করে পতেঙ্গা থানায় মামলা করেন এবং ১২ জনকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখান।

নৌ পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশ থেকে দেশে আমদানি করা অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের মাদার ভেসেলের অসাধু কিছু মাস্টার, সুকানি ও কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজসে চলে আসছে এই তেলপাচার কারবার। জাহাজে থাকা নাবিক এবং অন্য স্টাফদের জন্য খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জাহাজে পৌঁছে দেয়ার নাম করে সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ থেকে নামানো হয় হাজার হাজার লিটার তেল আর পরে তা লাইটারেজ জাহাজে করে আনা হয় স্থলে। তেলের ভাউচার করে খালাসের পর তা ড্রাম করে বিক্রি করে দেওয়া হয় বলে জানান মামলা তদন্তকারীরা।

তবে মামলার আসামি হলেও এখনো হারুনকে গ্রেপ্তার করেনি নৌপুলিশ। পুলিশ বলছে, জামিনে থাকায় তাকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা যায়নি। তদন্তকারীরা বলছেন, তদন্তে বেশকিছু নাম এসেছে এবং মামলার তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।

চট্টগ্রাম সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে। আমরা খুব শিগগিরিই এই মামলায় চার্জশিট দেব। আমরা জব্দ করা তেলের নমুনা চট্টগ্রামের বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা পরিষদের ল্যাবে পাঠিয়ে ছিলাম সেখান থেকে বলা হয়েছে তেলটি অপরিশোধিত সয়াবিন/পাম ভোজ্যতেল।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, 'তদন্তকালে আমরা জানতে পেরেছি, বিদেশ থেকে আসা চট্টগ্রামের স্বনামধন্য একটি তেল কোম্পানির অধীনে থাকা মাদার ভেসেল থেকেই এই ১১ হাজার লিটার তেল খালাস করা হয়েছিল।'

'মাদার ভেসেলটি বহির্নোঙরে থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তেল খালাসের জন্য অপেক্ষা করছিল বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি,' বলেন তিনি।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৌ পুলিশের পুলিশ সুপার মো. মমিনুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা মামলাটি তদন্ত করছি। এই চক্রটি শক্তিশালী এবং নানা কৌশলে তারা এই কাজটি করে আসছে জাহাজের মাস্টার, সুকানিসহ অন্যান্য স্টাফদের হাত করে।'

আগেও চোরাই তেলসহ ধরা পড়েছিল 'এমভি তানিশা'

নৌ পুলিশের আগে চোরাই তেলসহ কর্ণফুলী নদীতে আরও একবার ধরা পড়েছিলো 'এমভি তানিশা'। কোস্টগার্ড পূর্ব জোন ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে ১৩ হাজার লিটার তেলসহ জব্দ হয় জাহাজটি। পরে জাহাজে ও তেলের কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে জাহাজটিকে কাস্টমসের কাছে হস্তান্তর করে কোস্টগার্ড কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তখন কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি বলে জানিয়েছে কাস্টমস ও পুলিশ সূত্র।

কে এই হারুন?

চট্টগ্রামের ইপিজেড থানা এলাকায় হারুন নিজেকে একজন উঠতি আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে দাবি করেন। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নানা অনুষ্ঠানে তার রয়েছে সরব উপস্থিতি। বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার ব্যানার ও পোস্টার। হারুন বর্তমান ইপিজেড ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সমুনের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসাবে পরিচিত। তবে ইপিজেড-পতেঙ্গা পুলিশ তাকে তেলপাচারকারী হিসেবেই চেনে বলে জানিয়েছেন ইপিজেড ও পতেঙ্গা থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা। হারুনের বিরুদ্ধে ইপিজেড থানা ও পতেঙ্গা থানায় মারামারি ও চোরাকারবারের অভিযোগে মোট চারটি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ইপিজেড থানার একটি মামলায় সে চার্জশিটভুক্ত আসামি বলে জানিয়েছে থানা পুলিশ।

হারুন সম্পর্কে ৩৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, 'উনাকে আমি কলেজে পড়া অবস্থা থেকে চিনি। আগে যুবলীগ করতেন, এ ছাড়া স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের পদেও ছিলেন। উনি জাহাজে নিত্যপণ্য সরবরাহের ব্যবসা করেন। নিলামে জাহাজের মালামাল কেনা-বেচাও করেন।'

মেয়ে তানিশার নামেই হারুন 'তানিশা এন্টারপ্রাইজ' এবং 'এইচএম সাপ্লাইয়ারস' এর দুটো প্রতিষ্ঠান চালান। জাহাজ এমভি তানিশা এই 'তানিশা এন্টারপ্রাইজের' নামেই নেওয়া। নগরীর ইপিজেড-সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় এম রহমান টাওয়ারের ৪র্থ তলায় এই প্রতিষ্ঠান দুটোর অফিস। এই দুটো প্রতিষ্ঠান থেকেই সমুদ্রগামী জাহাজে বিভিন্ন ধরনের জিনিস সরবরাহ করা হয় বলে তাদের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন এই তেল পাচার সিন্ডিকেটের হারুনের সহযোগী তার শ্যালক ইলিয়াস। ইলিয়াস মূলত এই সিন্ডিকেটের ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে। এই সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য জসিম স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থাকে 'ম্যানেজ' করে থাকে।

জসিম নিজেকে বিভিন্ন জায়গায় একটি সরকারি সংস্থার সোর্স হিসাবে পরিচয় দেয় বলে জানান তদন্তকারীরা। তবে ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদক এই তথ্যটি নিশ্চিতভাবে যাচাই করতে পারেননি।

এমভি তানিশা জাহাজের বিভিন্ন কাগজপত্র এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। কাগজপত্র অনুযায়ী 'এমভি তানিশা' জাহাজটি হারুন এবং সাইফুল ইসলামের নামে রেজিস্ট্রিকৃত। নৌপরিবহন অধিদপ্তর (ডিজি শিপিং) থেকে এর লাইসেন্স হারুন এবং সাইফুলের নামে। ২৮ দশমিক ৯৭ মিটার লম্বা এবং ২ দশমিক ৭৪ ড্রাফটের এই বার্জটি বালুবাহী হিসাবে লাইসেন্স নেওয়া হয়। গত বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ নৌযানের চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

পুলিশে ধরা পড়ার পর আটক তেলকে জাহাজের 'স্লাজওয়েল' বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন হারুন। তবে পরীক্ষাগারে ভোজ্যতেল বলে প্রমাণিত হয়।

হারুনুর রশিদের ভাষ্য

তেল চোরাচালানের বিষয়ে হারুনকে জিজ্ঞাসা করলে দ্য ডেইলি স্টারকে ফোনে বলেন 'এমভি তানিশা দিয়ে আমি সমুদ্রগামী জাহাজে নানা আইটেম সরবরাহ করে থাকি। এবার আমরা এই জাহাজে করে অন্য একটি জাহাজ থেকে "স্লাজ ওয়েল" নিয়ে আসি কিন্তু পুলিশ আমার কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করেছে। মামলা আদালতে চলমান, আমি এবং আমার ভাই এখন জামিনে আছি।'

তেলের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে হারুন বলেন, 'আমরা জাহাজের ট্যাংকি থেকে তেল নিয়ে আসি। সেখানে কী থাকে না থাকে আমি জানি না।'

তবে বালুর জাহাজে কীভাবে এই তেল তিনি বহন করেছেন বা তা বহনের অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা আমার ভুল হয়েছে। আমি বিষয়টি বুঝতে পারিনি, এটা উচিত হয়নি।'

কোস্টগার্ডের কাছে আরও একবার তার জাহাজটি তেলসহ আটক হয়েছিল বলে তিনি স্বীকার করেন।

তেল চুরির সিন্ডিকেটের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'আমি ইপিজেড আওয়ামী লীগের সদস্য। তেল চোরাকারবারের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।'

Comments