আবহাওয়ার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক

ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি বেশ ভালোভাবেই জানান দিচ্ছে বর্ষার আগমনী বার্তা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর রিমঝিম বৃষ্টি ভিজিয়ে ফেলছে চারপাশ। বর্ষার ঘনঘটা যেন মানুষের মনকেও আপ্লুত করে তুলছে। এই বর্ষাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষাকাল। তাই বৃষ্টির প্রতি মুগ্ধতা থেকে রবিঠাকুর রচনা করেছেন ১১৫টির মত গান।

শুধু বর্ষাকাল নয়, আবহাওয়া বা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের মনের যোগাযোগ অত্যন্ত নিবিড়। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,

'আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে

জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে

মন লাগে না…'

তার কণ্ঠে বসন্ত ঋতু নিয়ে উচ্চারিত হয়েছে একই অনুযোগ, 'কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়..'

শুধু কবিসাহিত্যিক নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও  ঋতুর পরিবর্তন, তাপমাত্রা, বাতাস, সূর্য রশ্মি, বৃষ্টি কিংবা কুয়াশা, বাতাসের চাপ এবং দিনের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে মন মেজাজের তারতম্য তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা এই রোগের নাম দিয়েছেন  'সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার' যা এক ধরণের বিষন্নতাজনিত রোগ। এই রোগ সাধারণত ঋতু পরিবর্তনের সময় দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শীতকালে এই রোগের লক্ষণ দেখা যায়। শীতের দিন সূর্যরশ্মির প্রখরতা কমে যাওয়া এবং ক্রমাগত তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে মানুষের মনে এ ধরণের প্রভাব পড়ে বলে ধারণা করা হয়। তবে 'সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার' সাধারণত শীতে দেখা দিলেও অনেকের ক্ষেত্রে এটা গ্রীষ্মেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

গবেষণা

জার্মানির একদল গবেষক তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, আবহাওয়া মানুষের মানসিক অবস্থার উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করছে। জার্মানির বার্লিনের হামবোল্ট ইউনিভার্সিটির জ্যাপ ডিনিসিন গবেষণাটি পরিচালনা করেন। ১ হাজার ২৩৩ জনের উপর পরিচালিত গবেষণাটির সবাই ছিলেন জার্মানির অধিবাসী। যাদের অধিকাংশই নারী। তাদের গড় বয়স ২৮। তাদের মধ্যে ১৩ থেকে ৬৮ বয়সের নারী পুরুষও ছিলেন। গবেষকরা তাদের গবেষণায় প্রচলিত জ্ঞানের বিপরীতে দেখতে পেয়েছেন যে দৈনিক তাপমাত্রা, সূর্য রশ্মি, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বায়ু চাপ এবং দিনের দীর্ঘতার উপর মানুষের ইতিবাচক মনোভাবে কী ধরনের প্রভাব পড়ে। আর মনের ওপর ঋতুর এ প্রভাবকেই বলা হয় 'সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার'। ১৯৮৫ সালে এই রোগ সর্বপ্রথম জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে সূর্যের আলো যেসব দেশে কম থাকে সেসব দেশে 'সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার' হয়। রৌদ্রজ্জ্বল দিনে বিষণ্ণতা কম থাকে মন ভালো থাকে। সূর্যের আলো আমাদের মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। সূর্যের আলো কম, মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে মন খারাপ থাকে।'

লক্ষণ

বর্তমান প্রজন্মের কমবেশি সবাই 'ভাল্লাগে না' রোগে আক্রান্ত। আজকাল সোশাল মিডিয়া খুললেই এই শব্দটির বেশ ব্যবহার দেখা যায়। তথাকথিত সেই 'ভাল্লাগে না' রোগটি কিছু মানুষের ক্ষেত্রে বেড়ে যায় বিশেষ বিশেষ মৌসুমে। দুর্বলতা, ক্লান্তি, বিষণ্ণতা, কান্নার প্রবণতা, বিরক্তিভাব, কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, দাম্পত্য জীবনে অনীহা, নিদ্রাহীনতা, কর্মক্ষমতা হ্রাস, অতিরিক্ত খাওয়া বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা প্রভৃতি এই রোগের লক্ষণ। আবার গ্রীষ্মকালে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, ওজন কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, অল্পতেই কেঁদে ফেলা এ ধরণের লক্ষণ দেখা যেতে পারে। পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

কোন ঋতুতে বেশি হয়

'সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের' আরেক নাম 'উইন্টার ব্লুস'। ধারণা করা হয়, শীতকালের শুষ্কতার সঙ্গে এই রোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ শীতকালে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। তবে অন্যান্য ঋতুতে যেমন বর্ষাকাল, বসন্তকাল অনেকসময় গ্রীষ্মকালেও এই রোগের লক্ষণ দেখা যেতে পারে।

এই রোগের সঠিক কারণ সম্পর্কে জানা না গেলেও আমেরিকার সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এটা ঋতু পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকতে পারে, শীতের সময়ে সূর্যালোকের সঙ্গে যোগাযোগ কম হওয়ার কারণে মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মানুষ ঋতুজনিত বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'শীতকালে কিছু কিছু মানসিক রোগের হার বেড়ে যায়। এটি বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া যায়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য, আবেগের পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে।'

প্রতিকার

অনেকে বিষণ্ণতা বা অবসন্নতাকে 'বড়লোকের ঘোড়ারোগ' বলে অবিহিত করে থাকেন। কিন্তু শরীরকে বশে রাখতে মনের ঘোড়াটাকেও যে নাগালে রাখতে হয়, সেটা ভুলে যান অনেকেই। ঋতুজনিত বিষণ্ণতার লক্ষণগুলোর সঙ্গে আপনার মানসিক অবস্থা মিলে গেলেও ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। কিছুদিন সামলে চললে ঋতুর সঙ্গে বোঝাপড়াটা সহজ হয়ে যায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট সূর্যের আলোয় হাঁটাহাঁটি, নিয়মিত ব্যায়াম, নিজেকে প্রিয় কাজে ব্যস্ত রাখা, বন্ধু সান্নিধ্য ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এই সমস্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে রোগটি বাড়তে থাকলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধও সেবন করতে হতে পারে। পাশাপাশি লাইটথেরাপি ও সাইকোথেরাপি নিতে হতে পারে। এসএডি-র কারণে কর্মোদ্যম কমে যাওয়া, পিছিয়ে পড়া এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়তে পারে। তাই একে অবহেলা করা উচিত নয়।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda leaves London for Dhaka in air ambulance

Fakhrul urges BNP supporters to keep roads free, ensure SSC students can reach exam centres

9h ago