কুমিল্লা সিটি নির্বাচন: আ. লীগের ‘স্মার্ট মুভ’, সাক্কুর ঘরের শত্রু বিভীষণ

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার ফাইল ফটো

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির ভোট ব্যাংক দলটির বহিষ্কৃত ২ নেতার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

আরফানুল হক রিফাত তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক সাক্কুর চেয়ে ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ২ মেয়াদে মেয়র ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা সাক্কু বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন নিজামুদ্দীন কায়সার, যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। যার বেশিরভাগই সাক্কু পেতেন যদি তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতেন।

সাক্কু ও কায়সার মিলে মোট ভোট পেয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার।

দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় ২ জনকেই বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া, কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারণায় না যাওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয় বিএনপি।

কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ের মুদি দোকানের মালিক রমজান আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদি কায়সার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতেন তাহলে সাক্কু তার অধিকাংশ ভোট পেতেন। মূলত ঘোড়া (কায়সারের নির্বাচনী প্রতীক) টেবিল ঘড়ির (সাক্কুর নির্বাচনী প্রতীক) পরাজয় নিশ্চিত করেছে।'

স্থানীয়দের কয়েকজন জানান, সাক্কুর পরাজয়ের পেছনে অন্যান্য কারণ হিসেবে থাকতে পারে, তিনি ২ বার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এ ছাড়া, তিনি জলাবদ্ধতা ও যানজটসহ বেশকিছু নাগরিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কুমিল্লা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আজিম শিমুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং ভোটারদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকেও নিয়োজিত করেছে। অন্যদিকে, সাক্কু দলের কোনো সমর্থন পাননি।

ছিল 'বাহার ফ্যাক্টর'

অনেক ভোটার বলেছেন, রিফাত নির্বাচনে জয়ী হলেও এটি তার ব্যক্তিগত কারিশমা নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের জনপ্রিয়তা। তিনি দলীয় প্রার্থীকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিলেন।

রিফাত দলীয় প্রতীক 'নৌকা' নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিশেষ করে বাহারের অনুসারীরা তার পক্ষে জোর প্রচার চালান।

বাহার কুমিল্লা শহরের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা। ২০১২ সালের সিটি নির্বাচনে তিনি ও তার অনুসারীরা আওয়ামী লীগের মেয়র পদে আফজাল খানের পক্ষে কাজ করা থেকে বিরত ছিলেন।

২০১৭ সালে আফজালের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সিমা আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু, বাহার সে সময় তাকে সমর্থন দিতে অস্বীকার করেছিলেন। ২টি ক্ষেত্রেই তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন।

বলা যায়, এবারের নির্বাচনে দলটি 'স্মার্ট উদ্যোগ' হিসেবে রিফাতকে মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তবে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বলেছেন, বাহারই শেষ হাসি হেসেছেন।

তাদের ব্যাখ্যা, এই নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে স্থানীয় রাজনীতিতে বাহারের আধিপত্য আরও শক্তিশালী হয়েছে।

তবে, সব ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাক্কু বেশ ভালোভাবে লড়েছেন। রিফাতের সঙ্গে তার এতটাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে যে, ১০০টিরও বেশি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পরও কে বিজয়ী হবেন সেটা বেশ অনিশ্চিত ছিল।

সাবেক এই মেয়র জানিয়েছেন, তিনি নির্বাচনে পরাজিত হননি বরং তার জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছেন। আমি কেন পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে যাব? আমি এই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করছি।'

এমনকি তিনি দাবি করেছেন, একটি ফোন কল আসার পর ফলাফল পাল্টে গেছে।

নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকলেও সাক্কু ও তার অনুসারীরা এবং কয়েকজন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের দাবি ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছিল।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কুমিল্লা জেলা সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তবে, শেষ ৪ কেন্দ্রের ফল ঘোষণায় দেরি হওয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।'

তিনি আরও বলেন, '১০১টি কেন্দ্রের ভোটের ফল ঘোষণা হয়ে গেলেও মাত্র ৪টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করতে সময় লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা এবং এখানেই স্বচ্ছতার বিষয়ে সমস্যা রয়েছে।'

কুমিল্লার রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহসানুল কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্বাচনের পরিবেশ খুবই ভালো ছিল। কিন্তু, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অদক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে।'

টমসম ব্রিজ এলাকার এক হোটেল মালিক ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি মনে করেন নির্বাচনী ফলাফলে কোনো কারচুপি হয়নি। তার মতে, '২ প্রতিদ্বন্দ্বী খুব ভালোভাবে লড়াই করেছেন এবং ব্যবধান খুব সামান্য ছিল। তাই, সাক্কু সহজে ফল মেনে নিতে পারেননি।'

নির্বাচনে ভোট দিতে সম্প্রতি বাড়ি আসা কুমিল্লার প্রবাসী সাংবাদিক এহসান লেনিন বলেন, 'শেষ মুহূর্তের নাটকটি সাক্কুর কৌশল হতে পারে। তবে, স্পষ্টতই এই দেরি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশাল বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।'

ফোনকল পাওয়ার পর ভোটের ফলাফল পরিবর্তনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন রিটার্নিং অফিসার শাহেদুন্নবী চৌধুরী। তার দাবি, তিনি আসলে সেখানে সৃষ্ট পরিস্থিতির বিষয়ে সিইসি, ডিসি ও এসপির সঙ্গে কথা বলেছেন।

৪ কেন্দ্রের ফল ঘোষণায় বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, 'তখন বৃষ্টি হচ্ছিল এবং ভোটের সময় বিদ্যুৎ বিঘ্নিত হয়েছিল; তাই ৪ কেন্দ্রের ফল আসতে দেরি হয়েছে।'

এ ছাড়া, ঘটনাস্থলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বলেও জানান তিনি।

'আর কোনো কারণ ছিল না। পরিস্থিতি আমাদের বিরুদ্ধে ছিল এবং সে কারণে সময় লেগেছে। ফলাফল ঘোষণার সময় ২ পক্ষ (রিফাত ও সাক্কু) বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি করে।'

গত রাতে ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, 'প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রভিত্তিক টালির কপি থাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ফল পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই।'

'তবে কারও সন্দেহ থাকলে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। আপনি যদি সেখানে সন্তুষ্ট না হন তাহলে আপিল করতে পারেন। হাইকোর্টে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।'

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, '১০১টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর ২ প্রার্থীর সমর্থকরা এসে পরিবেশ নষ্ট করেছে।'

'বিশৃঙ্খলার মধ্যে, ফলাফল ঘোষণা কীভাবে হবে? কে শুনবে? শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ১৫-২০ মিনিট সময় লেগেছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা এসপি, ডিসি ও আমাদের ফোন করে জানান। তারপর তারা পরিস্থিতি সামাল দেন।'

এর আগে বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কুমিল্লা সিটি নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে জানান, তারা খুশি বা হতাশ নয়, তারা শুধু তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Govt at it again, plans to promote retirees

"A list of around 400 retired officials is currently under review though it remains unclear how many of them will eventually be promoted"

9h ago