বগুড়ার ঐতিহ্য আলু ঘাটি

বগুড়ার আলু ঘাটি

বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব কিছু স্বাদ আছে, খাবার আছে, যা ঐ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে যায়। যেমন বগুড়া শহরকে আমরা চিনি দইয়ের জন্য, আবার কেউ চিনি লাল মরিচের জন্য। তবে বগুড়ার খাঁটি স্বাদ বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হয় তার ঘরোয়া রান্নার দিকে। আর সেই ঘরোয়া রান্নার একটি পদের নাম—আলু ঘাটি।

অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ আলু ঘাটি খান সাধারণত মাছ, ডিম অথবা শজনে দিয়ে। তবে বগুড়ায় আলু ঘাটি বলতেই বোঝায় গরুর মাংস দিয়ে আলু ঘাটি।

কীভাবে তৈরি হয়

প্রায় ৪০ বছর ধরে রাঁধুনির কাজ করেন বগুড়ার সোনাতলার আব্দুস সালাম। তিনি জানান, বিয়ে বাড়ি, মজলিস, পিকনিক হলেই ডাক পড়ে তার। আর ৪০ বছরে সবচেয়ে বেশি যে রান্নাটা তিনি করেছেন, তা হলো আলু ঘাটি।

আলু ঘাটি

আব্দুস সালামের মতে, বগুড়ার এই সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী খাবারটি রান্না করতে প্রয়োজন হয় কিছু সহজলভ্য উপকরণ। যেমন- আলু, গরুর মাংস, ঘরোয়া কিছু মসলা আর হাতে পর্যাপ্ত সময়।

আলু ঘাটি মূলত একটি মিশ্র খাবার। যেখানে আলু আর গরুর মাংস একসঙ্গে কষিয়ে তৈরি করা হয়। রান্না শুরু হয় আলু সেদ্ধ করে। তারপর খোসা ছাড়িয়ে হাতে ভেঙে নেওয়া হয় ছোট ছোট টুকরোতে। অন্যদিকে গরম তেলে ফোড়ন হিসেবে পড়ে তেজপাতা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, গোলমরিচ। তারপরে কুচানো পেঁয়াজ, আদা-রসুন বাটা, হলুদ, মরিচ, ধনে আর জিরা গুঁড়ো মিশিয়ে কষানো হয় গরুর মাংস।

মাংস যখন প্রায় সেদ্ধ, তখন তাতে যোগ হয় আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা ভাঙা আলু। এরপর আলুর সঙ্গে মাংসের এই মিশ্রণকে আরও কিছুক্ষণ কষানো হয়, যাতে স্বাদ মিশে যায় একে অপরের সঙ্গে। শেষে পাঁচফোঁড়নের ঝাঁজ, কাঁচামরিচ, রসুন-পেঁয়াজের তেলে ভাজা ঘ্রাণ আর রাঁধুনির হাতের জাদু—সব মিলিয়ে রান্না হয় আলু ঘাটি।

কী উপলক্ষে খাওয়া হয়

বগুড়ায় আলু ঘাটি খাওয়া হয় বিশেষ করে বড় কোনো আয়োজনে। যেমন মজলিস, কুলখানি বা কেউ রোজা উপলক্ষে মানুষকে খাওয়াবেন, অথবা কোনো ওয়াজ মাহফিল শেষে আগত মানুষ আপ্যায়নে কিংবা ওরশ মাহফিলে এই আলু ঘাটি খাওয়া হয়। এছাড়াও বন্ধুরা সবাই মিলে এক হয়ে গেট টুগেদার বা পিকনিকের আয়োজন করলেও এই আলু ঘাটি খেয়ে থাকেন।

কেন এই আয়োজনগুলোতে আলু ঘাটি রান্না হয় জানতে চাইলে আব্দুস সালাম বলেন, 'কেন রান্না হয় বলতে, বগুড়ার কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার মতো খাবারই তো এই একটা। যে দাওয়াতে আলু ঘাটি থাকে না সে দাওয়াতে লোক কম থাকে। এছাড়া এক পাকে রান্না হয়, ঝামেলা কম দেখেও আলু ঘাটি বেশি রান্না হয়। সাদা ভাতের সঙ্গে এই আলুঘাটির জুড়ি নেই।'

আবার কোনো বিশেষ উপলক্ষ ছাড়াও রান্না হয় আলু ঘাটি। অনেক সময় এই খাবার থাকে দুপুরের ভাতের সঙ্গী হিসেবে। বিশেষ করে কোরবানি ঈদের মাংস দিয়ে রান্না হয় এই খাবার।

হোটেল বা রেস্তোরাঁতেও আলু ঘাটি

মজলিস না হলে যে এই খাবারটি খেতে পারবেন না খাবারপ্রেমীরা তা কিন্তু না। এখন খাবারপ্রেমীরা এই ঐতিহ্য খুঁজে পান বগুড়ার বেশকিছু নামী রেস্টুরেন্টে। বগুড়ার সাতমাথা, নাটোর রোড কিংবা মালতীনগরের কিছু খাবারের দোকানে পাওয়া যায় এই ঘরোয়া স্বাদের খাবারটি।

স্মৃতির সঙ্গে আলু ঘাটি

বগুড়ার অনেক বাড়িতে আলু ঘাটি একেবারে ছোটবেলার রান্নাঘরের স্মৃতি তৈরি করে দেয়।

স্থানীয় সাবিহা সুলতানা রিনা বলেন, 'আমাদের বাড়িতে কোনো আত্মীয়স্বজন এলেই রান্না হয় আলু ঘাটি। রান্নাটা এক ঐতিহ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এটি রান্না শিখেছি আমার মায়ের কাছ থেকে, আমার মা শিখেছেন আমার দাদির কাছ থেকে। এই পদটি নতুন প্রজন্মের রান্নাঘরেও টিকে আছে ঠিক আগের মতোই। কেউ হয়তো মুঠোফোনে ইউটিউব দেখে আলু ঘাটি রান্না করছেন, আবার কেউ মায়ের থেকে শেখা রান্নায় যোগ করছেন নিজের ছোঁয়া'।

ঐতিহ্যের আলু ঘাটি

বগুড়ায় কীভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে এলো এই আলু ঘাটি তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে স্থানীরা জানান, বগুড়ায় প্রচুর পরিমাণে আলু উৎপাদন হয়। তাই অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলে আলু ঘাটির প্রচলন। কেউ হয়তো গরুর মাংস দিয়ে আলু ঘাটি খান, আবার কেউ খাসির মাংস দিয়ে।

আলু ঘাটি বিষয়ে কথা হয় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ কবি ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক খৈয়াম কাদেরের সঙ্গে।

তিনি জানান, আলু ঘাটি বগুড়া অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী একটি জনপ্রিয় খাবার। এটি গরুর মাংস অথবা খাসির মাংসের সঙ্গে গোল আলু এবং নানা প্রকার দেশীয় মসলার ব্যঞ্জন মিশিয়ে রান্না করা এক বিশেষ ধরনের তরকারি। এর স্বাদ অনন্য।

খৈয়াম কাদের জানান, বগুড়া-অঞ্চলের যেকোনো পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক বা দাপ্তরিক আনন্দ-আয়োজনে আলু ঘাটি পরিবেশন একটি অনিবার্য বিষয়। দেশের অনান্য অঞ্চল থেকে, এমনকি ভিনদেশ থেকে যারা বগুড়ায় বেড়াতে আসেন তারাও আলু ঘাটির অনন্য স্বাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।

তিনি আরও বলেন, 'বগুড়া-অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী আমরা সবাই অতি শৈশব থেকেই এই আলু ঘাটির সঙ্গে পরিচিত। এখনও আলু ঘাটির ব্যবস্থা থাকবে এমন আয়োজনের আমন্ত্রণ সাধারণত হাতছাড়া করি না। বগুড়ার দই এবং কটকটির মতো আলু ঘাটিও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের একটি প্রকৃষ্ট উপাদান।'

বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতি শুধু রাজধানী বা জনপ্রিয় হোটেল-রেস্টুরেন্টের খাবারে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এমন বহু আঞ্চলিক পদ আছে, যেগুলো একেকটি অঞ্চলের স্বকীয় পরিচয়ের মতো কাজ করে। আলু ঘাটি তেমনই একটি খাবার।

 

Comments

The Daily Star  | English
govt employees punishment rule

Govt employees can now be punished for infractions within 14 working days

Law ministry issues ordinance amending the Public Service Act, 2018

2h ago