আমাদের সায়ীদ স্যার…

দেশে সামান্য যে কজন মানুষ চিরায়ত আদর্শ আর মূল্যবোধের কথা বলতেন, সায়ীদ স্যার তাদের অন্যতম। ফলে কথা শুনে, কিংবা লেখা পড়ে তার প্রতি একধরণের গুণমুগ্ধতা কাজ করতো। ততদিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রও দেশের নামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সেটাও তার প্রতি আকর্ষণের একটা বড় উপলক্ষ।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে জানতাম। চিনতাম না। চেনার অবকাশ ছিল না। কেননা তিনি ঢাকা কলেজে পড়াতেন। আমি পড়েছি সুদূর মফস্বলে। পত্রপত্রিকায় তার লেখা বা বক্তৃতা দেখতাম, পড়তাম। টেলিভিশনে তার কথা শুনেছি। সেটাও তার প্রতি একটা বড় আকর্ষণ।

দেশে সামান্য যে কজন মানুষ চিরায়ত আদর্শ আর মূল্যবোধের কথা বলতেন, সায়ীদ স্যার তাদের অন্যতম। ফলে কথা শুনে, কিংবা লেখা পড়ে তার প্রতি একধরণের গুণমুগ্ধতা কাজ করতো। ততদিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রও দেশের নামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সেটাও তার প্রতি আকর্ষণের একটা বড় উপলক্ষ।

প্রকৌশলবিদ্যায় গ্রাজুয়েশন শেষ করে তখন বিদ্যুৎ বিভাগের একটি শাখায় কাজ করছি পূর্ণোদ্যমে। কিছুকাল পর বুঝতে পারলাম, আমি যে মানসিকতা লালন করি সেটা নিয়ে চাকরি করা যাবে না। এখন বুঝি, খুব একটা কাঁচা আবেগ নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম। আমার কাছে তখন অর্থনৈতিক সততা আদর্শবাদের একমাত্র পথ হিসেবে প্রতিভাত। ফলে সবকিছু একটা সরল রেখার মতো দেখি। এ প্রবণতার কারণে চাকরিতে নানারকম সংকট তৈরি হতে লাগল। চাকরি যতটা মন দিয়ে করি, সংঘাতে জড়িয়ে পড়ি তারচেয়ে অনেক বেশি। একসময় চাকরি ছাড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম প্রাণপণে।

সবসময় ভাবতাম, জীবনে আরও অর্থবহ কাজ করা দরকার। যা করছি সেটা দিনগত পাপক্ষয় বলে মনে হতো সারাক্ষণ। নানারকম চেষ্টা যখন ব্যর্থ হতে লাগল, তখন একটা ছেলেমানুষি কাজ করলাম। নিজের কাঁচা আবেগ আর সরল স্বপ্ন নিয়ে আমি যা করতে পারলে আনন্দিত হবো, তার বয়ান দিয়ে চিঠি লিখলাম অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ—৩ জন খ্যাতিমান, স্বপ্ন দেখানো মানুষের কাছে। নব্বইয়ের দশকে এই ৩ জন তরুণদের কাছে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে দারুণভাবে প্রতিভাত।

৩ অধ্যাপকের মধ্যে কেবল সায়ীদ স্যারের সাড়া পেলাম। আমার চিঠি পড়ে তিনি আমাকে ফোন করলেন। তার আমন্ত্রণে ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এসে দেখা হলো সায়ীদ স্যারের সঙ্গে। কথা হলো মাসাধিক কাল, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘণ্টা দু-তিন ধরে। সেটা একটা আলাদা লেখার বিষয়। আপাতত সেদিকে না যাই। খুব দ্রুত সায়ীদ স্যারের কাজের প্রতি এবং ব্যক্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলল। আমি চাকরি ছেড়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে স্যারের ডেপুটি হিসেবে কাজে যোগ দিলাম। ২০০০ সালের মাঝামাঝি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যোগ দেই। চাকরি সূত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছাড়ি ২০০৬ সালের শেষের দিকে। বলা ভালো, এই সময়টাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। জীবনের বড় বাঁক বদলেরও সময়।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমি সায়ীদ স্যারের সঙ্গে যতটা বেশি সময় কাটানো যায় সেই চেষ্টা করেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেন্দ্রে এবং কেন্দ্রের বাইরে সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কাটানো সে সময়ে বহুবিধ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। নানা রকমের মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। একজন বহুমাত্রিক মানুষকে আবিষ্কার করেছি।

২.

একদিনের কথা মনে আছে। স্যারের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, একটি চিঠি সই করে পাঠাতে হবে সরকারি এক অফিসে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অফিস আওয়ার ছিল দুপুর থেকে রাত অবধি। সায়ীদ স্যার সাধারণত আসতেন সন্ধ্যার দিকে। বাইরে কোনো কাজ না থাকলে মধ্যরাত অবধি কাটিয়ে যেতেন কেন্দ্রে।

অফিসের সকল দাপ্তরিক কাজ, পরিকল্পনা, মিটিং এবং বাইরের যারা স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তাদের সঙ্গে কথা-আড্ডা সবই চলতো এ সময়ে। অনেকটা আধা পেশাদারি, আধা অপেশাদারি কায়দায়। সায়ীদ স্যার বসতেন কেন্দ্রে দোতলার হাফ রুমটিতে। খোলামেলা এই রুমেই ছিল স্যারের অফিস কাম বসার জায়গা।

সায়ীদ স্যার আলাদা করে কেন্দ্রে তার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো অফিস রুম তখন চালু করেননি। নীচে আম গাছের কোণে ছোট যে রুমটিতে আমি বসতাম, সেখানেও স্যার দিনের পর দিন তার দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে গেছেন। বলা বাহুল্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আজকের বহুতল ভবন তখনো হয়নি।

স্যার আসলেন। স্যারকে চিঠিটা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্যাডে প্রিন্ট করে দেওয়া হলো সই করার জন্য। স্যার তখন চিঠিতে সই করতেন, 'চেয়ারম্যান, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র' পদবী ব্যবহার করে। চিঠিটি সই হলে শাহজাহান ভাই নিয়ে যাবেন। শাহজাহান ভাই মূলত ছিলেন সচিবালয়ে কোনো এক মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে খন্ডকালীন কাজ করতেন হিসাব বিভাগে।

পরদিন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে চিঠিটি, ফলে সবারই তাড়া ছিল। স্যার চিঠিটি পড়লেন এবং কিছু কারেকশন দিলেন। প্রিন্ট করে স্যারকে দেওয়া হলে, আবারও কারেকশন করলেন। পরেরবার বললেন, আজ থাক, বাসায় পাঠিয়ে দাও, কালকে দেখবো। তখন স্যার কেন্দ্রে আগত এক অতিথির সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। স্যারের এই মগ্নতা ছিল আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। শিশুর মতো সারল্যে গভীরতর আনন্দে সায়ীদ স্যার এই মগ্নতায় ডুবে যেতেন।

চিঠিটি পরের দিনও পাঠানো গেল না। স্যারের বারংবার কারেকশনের পরও চিঠিটা চূড়ান্তভাবে সই করা গেল না বলে হিসাব বিভাগের লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। আমি গেলাম চিঠিটি সই করানোর জন্য। আমার হাত থেকে চিঠিটি নিয়ে আবার স্যার মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। নতুন শব্দ যোগ করলেন। এভাবে চলতেই থাকল।

একসময় আমি একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠলাম, স্যার একটা চিঠি পাঠাতেই যদি আমরা এতো সময় নেই, তাহলে তো কাজ সব বন্ধ হয়ে যাবে। আমার বিরক্তি স্যারের কাছে গোপন থাকল না। স্যার একটু স্বরটা চড়া করেই বললেন, 'চিঠিটা কার স্বাক্ষরে যাবে, তোমার না আমার?' বললাম, আপনার! 'তাহলে তো একটু দেখেই দেওয়া দরকার, তাই না। এটার সঙ্গে আমার ভাবমূর্তি জড়িত। এই চিঠিতে যদি একটা শব্দও ভুল থাকে, তাহলে সবাই পরিহাস করে বলবে—দেখো, এ ভদ্রলোক নাকি আলোকিত মানুষ বানায়! আমার সারা জীবনের সবচেষ্টা এক মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে!'

আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি। কোনো কথাই বললাম না। স্যার সেটা খেয়াল করে চিঠিটা সই করে গলার স্বরটা নামিয়ে একটা মায়াবী কণ্ঠে বললেন, 'দেখো, এটা হচ্ছে পারফেকশনের প্রশ্ন। আমি তো কোন ছার! রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি দেখবে, পারফেকশন কাকে বলে? এক লেখা কতবার কাটাকুটি করেছেন!'

সায়ীদ স্যার নিজের কাজের ব্যাপারে, বিশেষ করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিষয়ে এতটাই সজাগ ও সাবধান থাকতেন। তার কোনো কাজের বিষয়ে কেও যাতে প্রশ্ন তুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভাবমূর্তি নিয়ে সংশয় না জাগায় সে বিষয়ে স্যার থাকতেন সদাসতর্ক।

আরেকদিনের কথা মনে পড়ছে। আমি আর স্যার যাচ্ছি সাভারের দিকে, কোনো একটা কাজে। গাড়ি চালাচ্ছেন সায়ীদ স্যার নিজেই। স্যারের খুব পুরনো সিলভার কালারের ছোটখাটো একটা টয়োটা গাড়ি ছিল। বহুদিন অবধি সেটাই স্যার ব্যবহার করেছেন। গাড়িটি প্রায়ই পথিমধ্যে বন্ধ হয়ে যেতো। সহযাত্রীদের সেটা ঠেলতে হতো। কেন্দ্রে একটা কথা চালু ছিল যে স্যারের এই গাড়ি কেন্দ্রের কে ঠেলেনি? দেশের প্রায় সব সেলিব্রেটিই, যারা সায়ীদ স্যারের এই গাড়িতে বিভিন্ন সময়ে সফরসঙ্গী হয়েছেন, এই গাড়ি কোনো না কোনো সময় ঠেলেছেন।

তবে একটা কথা বলতে হয়, সায়ীদ স্যার খুব ভালো গাড়ি চালাতেন। প্রায় ৫ দশকের বেশি সময় ধরে গাড়ি চালিয়েছেন। গাড়ির কলকব্জা কিংবা অটোমোবাইল সম্পর্কে স্যারের ধারণাও ছিল খুব স্পষ্ট। গাড়ির যে কোনো সমস্যা তিনি ধরতে পারতেন সহসাই। এ বিষয়ে গাড়ির মেকানিকদের চাইতেও স্যার ছিলেন এক কাঠি সরেস।

যা হোক, আমি আর স্যার কথা বলতে বলতে চলেছি। গাড়িটি সাভারের আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডমের কাছাকাছি। রাস্তা বেশ ফাঁকা। হঠাৎ একটা ছাগল এসে গেলো গাড়ির সামনে কোনো রকম নোটিশ ছাড়াই। স্যার খুব জোরে ব্রেক করলেন। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই আমরা থামলাম। সায়ীদ স্যার গাড়িটা এক পাশে থামালেন। স্টার্ট বন্ধ করে অনেকক্ষণ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলেন। মনে হলো, পুরো ঘটনায় স্যার খুব ডিপ্রেসড।

আমি বিষয়টা হালকা করতে বললাম, স্যার এতো ভাবছেন কেন? এখানে তো আপনার কোনো দোষ নেই। আর কোনো দুর্ঘটনাও তো ঘটেনি। স্যার একটু মুচকি হাসলেন আমার কথায়। বললেন, 'এ দেশের মানুষকে তো এখনো চেনোনি! কিছু একটা হলে আগামীকাল পত্রিকায় হেডিং দেখতে, "আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগরের হাতে ছাগলের মৃত্যু!" আমার সারাজীবনের সবচেষ্টা এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে যেত!'

৩.

পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে স্যারের তখন বিরাট উৎসাহ। সায়ীদ স্যার নিত্য নতুন কাজের মধ্যে প্রাণ পেতেন। নতুন উদ্যম, নতুন উদ্যোগ তাকে অধিকতর সচল করে তুলত। সায়ীদ স্যারের পরিবেশ আন্দোলনে সক্রিয়তা সরকারের নজর কাড়ল, বিশেষত মিডিয়ার কল্যাণে। নদী দখল, নদী দূষণের বিরুদ্ধে সায়ীদ স্যার বেশ সোচ্চার। প্রায়ই টিভিতে এ নিয়ে কথা বলছেন, পত্র-পত্রিকায় লিখছেন। প্রথমবারের মতো একটা সিভিল সোসাইটি আন্দোলন গড়ে উঠছে। মিডিয়ায় তা সম্ভ্রমও পাচ্ছে।

এ সময়ই ঢাকার চারপাশে ঘিরে থাকা নদীগুলোর দখল উচ্ছেদ করে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর ইচ্ছে প্রকাশ করে সরকার একটা হাইপাওয়ার কমিটি তৈরি করলো। সরকারের সংশ্লিষ্ট ৫ মন্ত্রণালয়ের ৫ জন খুবই প্রভাবশালী মন্ত্রী এই কমিটিতে থাকলেন। সঙ্গে রাখা হলো সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে।

এটা বিএনপির আমল। এ কমিটির সদস্য শক্তিমান মন্ত্রী মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন প্রমুখ। মাঝে মাঝে মিটিং হয়। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্যার এই মিটিংয়ে যান না। কেননা তিনি মনে করেন, এসব কমিটি শেষাবধি কোনো ফলপ্রসূ কিছু করতে পারবে না। তার ধারণা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে তিনি যতটা চিনেছেন, তাতে এগুলো এক ধরনের প্রহসন। ফলে নীতিগতভাবেই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এসব মিটিংয়ে থাকতেন না।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালে ভদ্রে হাজির হতেন। কিন্তু ব্যতিক্রম সায়ীদ স্যার। যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে পরিবর্তনের আশায় স্যার এ বিষয়ে খুবই সক্রিয়। স্যার আমাদের বলতেন, রাষ্ট্র হচ্ছে একটা জগদ্দল পাথর। একে ক্রমাগত ঠেলতে হবে জনস্বার্থেই। সিভিল সোসাইটির কাজই হচ্ছে সেটা। ফলে এসব মিটিংয়ে সায়ীদ স্যারকেই পাওয়া যেতো নিয়মিত।

একবারের মিটিংয়ে স্যার নির্দিষ্ট সময়ের একটু পরে ঢুকেছেন। সায়ীদ স্যারকে দেখেই মন্ত্রী মির্জা আব্বাস বলে উঠলেন, 'এই যে সিভিল সোসাইটির এতো আওয়াজ, মিটিংয়ে তো সায়ীদ সাহেব ছাড়া আর কাওকে দেখা যায় যায় না।' স্যার কথাটা শুনে হাসতে হাসতেই বললেন, 'আরে সিভিল সোসাইটি হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এর একটা থাকলেই যথেষ্ট।' স্যারের কথায় মিটিং রুমে তখন হাসির রোল পড়ল। এভাবেই হাস্যরসের মধ্য দিয়ে সায়ীদ স্যার আক্রমণের জবাব দিতেন।

আরেকবার ক্ষমতাসীন এক সরকারের আমলে এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে কথা উঠল, সায়ীদ সাহেব তো আগের সরকারের সঙ্গেও কাজ করেছেন। বলাবাহুল্য এটা বলে স্যারকে একটু আক্রমণই করা হলো। স্যার এটা শুনে একটু ধাতস্থ হয়েই হাসতে হাসতে বললেন, 'দেখেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমরা সরকারের যৎসামান্য সাহায্য পাই। ফলে সরকারের লোকজনের সঙ্গে আমাকে মিটিং করতে হয়। তাদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। আমি তো আপনাদের সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে চাই। তো সরকারে আপনারা আসতে না পারলে আমি কী করব? আপনারা সরকার গঠন করতে পারেননি, সেই ব্যর্থতার দায় আমার উপর চাপাচ্ছেন কেন?' যথারীতি হাস্যরসেই সেই মিটিং শেষ হলো।

৪.

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির কথা। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) সেদিন ছুরিকাহত হয়ে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। সেকারণেই দিনটির কথা মনে আছে। এদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একসময়ের খ্যাতিমান এনজিও 'প্রশিকা'র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট ড. কাজী ফারুক আহমদ এসেছেন সায়ীদ স্যারের সঙ্গে মিটিং করতে।

প্রশিকা তখন দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভাইব্রেন্ট এনজিও। বলা চলে, শিল্প-সংস্কৃতি খাতে বড় ও গতিশীল লোকাল ডোনার এনজিও। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি খাতে তাদের বিরাট অবদান। অনেককে তারা নানাখাতে টাকা-পয়সা দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। ওখানকার ফিল্ম ও মিডিয়া বিভাগের কল্যাণেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চলচ্চিত্র চক্র তখন কিছু টাকা পেয়েছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর কেনার জন্য। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই সায়ীদ স্যার রাজি হয়েছেন এই মিটিং করতে।

ড. কাজী ফারুক সাহেব তখন এনজিও থেকে রাজনীতির দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। 'ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন' নামে নিজেই একটা রাজনৈতিক দল গঠন করতে উদ্যোগী হয়েছেন। নানাজনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছেন। সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কথা বলতে ফারুক সাহেবের আসাও সে উদ্দেশ্যেই। মিটিংয়ে উপস্থিত আমরা ৪ জন। সায়ীদ স্যার, ড. ফারুক আহমদ, প্রশিকার একজন কর্মকর্তা ও আমি।

স্যার প্রথমত ড. কাজী ফারুক সাহেবের কথা শুনলেন। ফারুক সাহেব বললেন, তিনি দেশের পরিবর্তন চান। তাই রাজনৈতিক দল করতে মনস্থির করেছেন। তিনি দেশে নানা ক্ষেত্রে কীর্তিমান সায়ীদ স্যারের মতো আরও যারা আছেন, তাদেরকে সঙ্গে নিতে চান এই মহতী উদ্যোগে।

স্যার জানতে চাইলেন, যেমন? ফারুক সাহেব বললেন, ধরুন, আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকেও নিলাম। আপনাকেও পেলাম। তাহলে কামাল হোসেনের যেখানে দুর্বলতা, সেখানে আপনার সবলতাকে কাজে লাগাবো। আবার আপনার যেখানে দুর্বলতা সেখানে কামাল হোসেন সাহেবের সবলতাকে কাজে লাগাবো। এভাবে সবার গুণকে, সবার শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলেই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে।

সায়ীদ স্যার এবার তার স্বভাবসুলভ উইট দিয়ে বললেন, 'দেখেন, আমার সারা জীবনের পুণ্য দিয়ে ড. কামাল হোসেনের পাপমোচন করতে হবে!' বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। তখন অবশ্য খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেন দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত খনি করে কয়লা তোলার দায়ে মানুষ খুনে অভিযুক্ত এশিয়া এনার্জির আইনজীবী হিসেবে বেশ সমালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছেন।

এরপর সায়ীদ স্যার সিরিয়াস ভঙ্গিতেই ফারুক সাহেবকে বললেন, দেখেন, সব দেশেই রাজনীতির বাইরে কিছু আলাদা মানুষ থাকেন। তারা নিজ নিজ ফিল্ডে কাজ করেন। যেমন: আপনিও জীবনভর এনজিও ফিল্ডে কাজ করছেন। সেটাই আপনার করা উচিত। কেননা এটাই আপনার জায়গা। রাজনীতি আপনার ফিল্ড নয়। ওখানে আপনি ভালো করতে পারবেন না।

কিন্তু ফারুক সাহেব নাছোড়বান্দা। তখন তিনি রাজনীতি করতেই মরিয়া। আলোচনায় এটা পরিষ্কার হয়ে উঠলো, সায়ীদ স্যার ফারুক সাহেবের রাজনীতি করার উদ্যোগকে ভুল উদ্যোগ মনে করছেন। আবার ফারুক সাহেবও যুক্তি দিয়ে সায়ীদ স্যারকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত করতে রাজি করাতে পারলেন না। মিটিং এভাবেই শেষ হলো।

পরে অবশ্য সায়ীদ স্যারের ভবিষ্যতবাণীই সত্য প্রমাণিত হয়। ফারুক সাহেব রাজনীতিতে সফলভাবেই ব্যর্থ হন। যার ঝাপটা লাগে প্রশিকার ওপর। ফারুক সাহেবের দুর্দিন দিনে দিনে প্রশিকাকে দুর্বল করতে থাকে।

৫.

এরকম বহু টুকরো ঘটনা ও অভিজ্ঞতা আছে সায়ীদ স্যারের সঙ্গে। জীবনকে ভালোবেসে, মানুষের হৃদয়কে জাগ্রত করার স্বপ্ন নিয়ে, গভীরতর আনন্দে যে কাজ করা যায় সেটা সায়ীদ স্যারকে না দেখলে কখনো জানা হতো না। বই পড়ানোর মতো দুরূহতম বিমূর্ত কাজকে বহুবিধ নিত্যনতুন আইডিয়ার মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর সপ্রাণ-সচল রাখার যে কষ্টকর প্রচেষ্টা ধ্যানমগ্নতায় সায়ীদ স্যার করে চলেছেন, সেজন্য স্যার আমাদের নমস্য। সহ্যক্ষমতায়, হাসিমুখে সমালোচনা গ্রহণের অদম্য শক্তিতে আমার ধারণা সায়ীদ স্যার এ দেশে খুবই ব্যতিক্রমী মানুষ। শিশুর মতো সরল মন, আর মানুষের প্রতি গভীরতর মমতায় ভরা তার সম্পূর্ণ হৃদয়ের বিনয়ী ছোঁয়া যে আমরা পেলাম, সেটা আমাদের পরম সৌভাগ্য।

২৫ জুলাই জন্মদিনে তাই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সায়ীদ স্যারের কাজ, কথা, বিপুলতর উৎকর্ষমণ্ডিত লেখা, বহুবিচিত্র উদ্যম, বর্ণিলসব উদ্যোগ বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে বহুভাবে, অনাগতকাল ধরেই প্রেরণা জোগাবে বলে আমার প্রতীতি ও বিশ্বাস।

শুভ জন্মদিন স্যার। অভিনন্দন। শুভকামনা।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাবেক সমন্বয়কারী

Comments