ওয়ারীর ‘৪০০ বছরের’ পুরোনো সমাধিক্ষেত্র
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/11/16/img20231102193310_1_0.jpg?itok=j9OuqDV4×tamp=1700140285)
পুরান ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত সুপ্রাচীন একটি খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রের ব্যাপারে হয়তো অনেকেই জানেন না। প্রতি বছর ২ নভেম্বর 'অল সোলস ডে'তে এর গেট খুলে দেওয়া হয়। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা এদিন তাদের গত হওয়া প্রিয়জনদের স্মরণে কবরগুলোতে মোম-প্রদীপ জ্বালিয়ে, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন।
আত্মাদের সদগতি লাভ ও পাপমোচনের জন্য প্রার্থনা করেন তারা। সকাল থেকেই ধর্মীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। আত্মার শান্তির জন্য কবরে ছিটানো হয় গোলাপজল। এই সিমেট্রিতে প্রতি বছরই ২ নভেম্বর সমবেত হন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা। অন্য ধর্মের মানুষরাও দেখতে ও ঘুরতে আসতে পারেন এই গোরস্থান।
রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাস মতে, মানুষের মৃত্যুর পর স্বর্গে প্রবেশের আগে আত্মাকে যেতে হয় পার্গেটরিতে। সেখান থেকে পরিপূর্ণভাবে পাপমুক্ত হয়ে আত্মারা প্রবেশ করতে পারে স্বর্গে। ৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর নভেম্বরের ২ তারিখ মৃতদের জন্য এই প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়, যা অল সোলস ডে নামে পরিচিত। প্রতিবছর এই দিনটিকে কেন্দ্র করে পদভারে মুখর হয়ে ওঠে খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রগুলো। গত ২ তারিখ আমারও সুযোগ হয়েছিল ওয়ারীর খ্রিস্টান কবরস্থানে যাওয়ার।
এই সমাধিক্ষেত্রটি ঠিক কতটা পুরোনো, তা স্পষ্ট জানা যায়নি। এক সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠার সময় উল্লেখ করা হয়েছে ১৬০০ সাল। সেই হিসেবে এর বয়স ছাড়িয়েছে ৪০০ বছর। সে সময় ঢাকায় ইউরোপের নানা দেশ থেকে বণিকরা আসছিলেন। পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, আর্মেনিয়ান, গ্রিক ও ইংরেজরা পর্যায়ক্রমে আসেন। এর সঙ্গে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন মিশরীয়রা। এদেশে বাইরের এই জাতিগুলোর মানুষ স্থায়ী হতে থাকেন। তাই বাড়ি-ঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো প্রয়োজন হয় সমাধিক্ষেত্রেরও।
এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, এই গোরস্থানে সবচেয়ে প্রাচীন যে কবরটি দেখা যায় তা জোসেফ পেজেট নামে এক ব্যক্তির। তিনি ছিলেন কলকাতার মন্ত্রী। ১৭২৪ সালের ২৬ মার্চ ২৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এই সমাধিটি এখন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/11/16/440px-grave_near_kolombo_shahib_tomb.jpg?itok=ZMqq7W7K×tamp=1700139957)
তবে এখানে এর চেয়েও পুরোনো কবর থাকা সম্ভব। কবরে এপিটাফের ব্যবহার ১৬৯০ সালের পরের ঘটনা। জব চার্নকের হাতে কলকাতার গোড়াপত্তনের পর ব্যবহার শুরু হয় এপিটাফের। কাজেই এর আগে থাকা প্রচুর কবর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু না।
জনশ্রুতি রয়েছে, এখানে একটি গির্জা ছিল। পর্যটক তাভেরনিয়ে তার তাভেরনিয়ের ভারত ভ্রমণে উল্লেখ করেছেন গির্জার কথা। সেটি ১৮৬৬ সালের কথা। তবে বর্তমানে এখানে তার কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই।
১৭৮৯ সালে অগাস্টানিয়ানদের তৈরি করা গির্জার তালিকায় এখানকার গির্জাটির উল্লেখ ছিল না। কাজেই এর আগেই কোনো এক সময় এটি ধ্বংস হয়।
তবে গির্জা ধ্বংস হয়ে গেলেও এখানে প্রচুর কবর সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, এখানে ৬ প্রকারের সমাধি রয়েছে।
টাইপ এ: এর অন্তর্ভুক্ত সমাধিগুলো বহু প্রাচীন। সেসবের আর কোনো ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে না।
টাইপ বি: সমাধিক্ষেত্রগুলো বহু বছর ধরে পরিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। মুরিয় ঘরানার তোরণ এতে দেখা যায়।
টাইপ সি, ডি, ই: এগুলোর সাদৃশ্য পাওয়া যায় কলকাতার সে সময়ের সমাধিগুলোর সঙ্গে। স্মৃতিস্তম্ভ ও কফিনের দিক থেকে কলকাতার সমাধির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখা এই সমাধিগুলোর ওপর পাকা ভিত্তি আছে। এর ওপরে থাকা স্মৃতিস্তম্ভ কোণাকুণিভাবে ওপরে উঠে একটি চূড়ায় শেষ হয়।
টাইপ এফ: এই সমাধিক্ষেত্রগুলো প্রচলিত ধরন থেকে আলাদা। এগুলো ডোরিক ধরনের। আয়ন কলামের দ্বারা অষ্টভুজাকৃতি ও বর্গাকৃতির হয়।
এই সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে বহু ধরনের কবর। ১৮২৪ সালে বিশপ রেজিনাল্ড হেয়ার ঢাকায় এসে এই সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রকরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। তিনি একটি কবরের ওপরে থাকা আটকোণা মিনার আকৃতির প্রশংসা করেন। এটিই এখানে থাকা জোসেফ পেজেটের কবর।
হেবার আরও কিছু সমাধির উল্লেখ করেন। যার ভেতর সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল কলম্বো সাহেবের সমাধি। টাইপ এফ ধরনে নির্মিত এই সমাধিটি প্রকৃতপক্ষে তিনটি সমাধির সমন্বয়ে গঠিত। এখন এর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে শুধু।
এই সমাধির স্মৃতিস্তম্ভে পাওয়া যায় মোগল স্থাপত্যের ছাপ। বর্গাকার এই সমাধির চারপাশে প্রতিদিকে রয়েছে চারটি করে দরজা। সমাধির শেষদিকে অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভে রয়েছে একটি স্বর্গীয় পরীর ছবি। এর শীর্ষে আছে গম্বুজ আচ্ছাদিত আটকোণা একটি বুরুজ। কলম্বো সাহেব আসলে কে, তার প্রকৃত নাম কী- কিছুই স্পষ্টভাবে জানা যায় না। কোম্পানির চাকুরে বলা হলেও চাকুরেদের কবরের যে তালিকা, তাতে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এর বাইরে এখানে আছে নিকোলাস পোগোজের কবরও। তিনি পোগোজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/11/16/uhefo49nhdzxrpvw_grave_0_1_1.jpg?itok=vH0RCivo×tamp=1700140093)
এ ছাড়া, সিপাহী বিদ্রোহের সময় নিহত দুজন সৈনিকের কবরও আছে এখানে। এর ভেতর একটি কবর হেনরি স্মিথের, যিনি ১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বর নিহত হন।
১৮৯২ সালে ঢাকার নবাবদের আমন্ত্রণে ঢাকায় নভোচারী হিসেবে এসে দুর্ঘটনায় নিহত জ্যানেট ভ্যান তাসেলকেও সমাধিস্থ করা হয়েছিল এখানেই। তবে সে সময় তার কবরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।
সমাধিক্ষেত্রটিতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন। বিশেষত অল সোলস ডেতে।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/11/16/img20231102193303_1_0.jpg?itok=6NfP48_y×tamp=1700140194)
মৃতদের স্বজনদের বাইরে দর্শনার্থীরাও আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী মো. ইমরান খান এখানে এসেছেন বেশ কয়েকবার।
তিনি বলেন, 'আমার বাসা থেকে কবরস্থানটি ৫ মিনিট দূরত্বে। কবরস্থানের দেয়ালের ওপারেই ছিল আমার স্কুল। ছোটবেলা থেকে এর প্রতি আকর্ষণ কাজ করত, কারণ ইতিহাসের বিষয়গুলো আমার বেশ প্রিয়। এই কবরস্থান ৪০০ বছরের পুরোনো। এর কাছে আরেকটি কবরস্থান আছে, যেটি ব্যাপটিস্টদের; ১৮৪৬ সালে হয়েছে। এখানে আসলে ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় হয়। কবরগুলো দেখতে কেমন ছিল তা জানা যায়।'
'আমি অল সোলস ডেতে প্রথম আসি ২০১৬-১৭ সালে। ওদিন গেট খুলে দেওয়া হয়। কবর-ক্রুশগুলো দেখার সুযোগ হয়। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সাইন ও এপিটাফগুলোর ভেতর নান্দনিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। আমি কাজের সুবাদে, ইন্টারভিউ নিতেও এসেছি। মৃতদের স্বজনরা মোম জ্বালিয়ে, গোলাপের পাপড়ি, গাঁদাফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখেন কবরগুলোকে। আমার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা দূর-দূরান্ত থেকেও এখানে ঘুরতে এসেছে। এখানে সবচেয়ে পুরনো এপিটাফটা ১৭২৪ সালের', যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'এখানকার কোনো কবর আঠারো শতকের, কোনোটা উনিশ শতকের। আবার, একই কবরে মা-বাবা, সন্তান শায়িত এমনও আছে। আমি এমনও দেখেছি প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার স্ত্রী ২০ বছর ধরে আসছেন মিরপুর থেকে। জীবদ্দশায় স্বামী কখনো স্ত্রীকে দেখেননি। কারণ স্বামী অন্ধ ছিলেন। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, ভালোবাসা থেকে স্ত্রী প্রতিবছর আসেন।'
Comments