দারিদ্র্য বাড়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও ভর্তুকি দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি-সরবরাহ কমেছে

দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি সংস্থাগুলোর ভর্তুকিমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি ও বিতরণ চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে। এটি দেশের অনেক কম আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলে বাজার দরের তুলনায় কম দামে ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনিসহ নিত্যপণ্য বিক্রি প্রায় দেড় মাস ধরে স্থগিত রেখেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, টিসিবির ট্রাকের মাধ্যমে নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য উপদেষ্টা পরিষদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, 'অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি আগামী সভায় তোলা হবে। অনুমোদন পেলেই বিক্রি শুরু হবে।'
পণ্য বিক্রি স্থগিতের আগে টিসিবি সপ্তাহে ছয় দিন একেকটি ট্রাক থেকে প্রায় ৪০০ জনের কাছে নিত্যপণ্য বিক্রি করত।
এ ছাড়া টিসিবির এক কোটি ফ্যামেলি কার্ডধারী নিম্নআয়ের পরিবারের কার্ডের মধ্যে বর্তমানে ৪৯ লাখের বেশি সচল আছে। বাকি কার্ডগুলো বিভিন্ন অনিয়মের মুখে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।
চলতি অর্থবছরের ৯ মে পর্যন্ত খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সংস্থাগুলো প্রায় ২৬ লাখ ৩২ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণ করেছে। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় পাঁচ শতাংশ কম।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে—দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ভিজিএফ ও ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় কম আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণও কমেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণ এমন এক সময়ে কমল যখন টানা ২৬ মাস ধরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের ওপরে।
ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি, চাকরি হারানো ও ধীর অর্থনীতির কারণে বিশ্বব্যাংক গত মাসে পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের সামগ্রিক দারিদ্র্য বেড়ে ২২ দশমিক নয় শতাংশ হতে পারে। ২০২২ সালে তা ছিল ১৮ দশমিক সাত শতাংশ।
প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে—চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা (দৈনিক সোয়া দুই ডলারের নিচে আয়) প্রায় দ্বিগুণ হয়ে নয় দশমিক তিন শতাংশ হতে পারে।
বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ 'অতিদরিদ্র' হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত দুই বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থা খারাপ হয়েছে।'
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি, বলেন তিনি।
তার মতে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের উচিত ছিল খাদ্য বিতরণ বাড়ানো ও টিসিবির ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি বিক্রি চলমান রাখা। তিনি বলেন, 'আশ্চর্যজনক বিষয় এই যে তা করা হয়নি।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে—চলতি অর্থবছরের ৮ মে পর্যন্ত এফডব্লিউপি কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬৩ দশমিক ২০ শতাংশ কমে ৫৯ হাজার ৭৩৬ টন হয়েছে।
ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় বিতরণ ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে এক লাখ ৫৩ হাজার টন হয়েছে। ভিজিডি কর্মসূচির ক্ষেত্রে খাদ্য বিতরণ আগের বছরের তুলনায় ৪০ দশমিক ২৬ শতাংশ কমে এক লাখ ৮৭ হাজার টন হয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন একজন মানুষ ভর্তুকি দামে যে পরিমাণ খাবার কিনতে পারেন তা তাদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না।'
এই প্রেক্ষাপটে কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি কমিয়ে দেওয়া বা স্থগিত রাখা বিপুল সংখ্যক কার্ডধারীদের জন্য বেশ উদ্বেগজনক বলে মনে করেন তিনি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যসীমার কাছে থাকা মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। অন্যদিকে যারা ইতোমধ্যে দরিদ্র তারা আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছেন।
তিনি মনে করেন, ভর্তুকি দামে খাদ্যপণ্য বিতরণ ও বিক্রি দুটোই বাড়াতে হবে।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার জানান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেড় লাখ টন চাল ও গম বিতরণ কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত আছে। বারবার মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তারা খাদ্যশস্য বিতরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শারমিন শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় সাধারণত বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার বিতরণ করা হয়। এ ছাড়াও, দুই ঈদে প্রায় দুই লাখ টন খাবার বিতরণ করা হয়।
আসন্ন ঈদুল আজহার জন্য এক লাখ টন খাদ্যশস্য এখনো বিতরণ করা হয়নি। আশা করা হচ্ছে, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে এটি পাঠানো সম্ভব হবে।
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি যা আগে বছরে পাঁচ মাস চালু ছিল, তা আগামী অর্থবছর থেকে ছয় মাস করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি সম্প্রসারণ ও কম আয়ের জনগোষ্ঠীকে বৃহত্তর সহায়তার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে খাদ্য ভর্তুকির বরাদ্দ প্রায় ১২ শতাংশ বাড়িয়ে আট হাজার ১০০ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা করেছে।
Comments