কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ করে ৭৫ কোটি টাকা লোকসানের মুখে ইউসিবি

২০২১ সালে পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগ ছিল ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার কিনতে ব্যয় করা হয় ১০৫ কোটি টাকা, যার বিনিয়োগের মূল্য এখন ২৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
ইউসিবি

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবি) শেয়ারবাজারে একটি শেয়ারে বিনিয়োগ করে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কায় আছে।

২০২১ সালে পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগ ছিল ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার কিনতে ব্যয় করা হয় ১০৫ কোটি টাকা, যার বিনিয়োগের মূল্য এখন ২৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ এখান থেকে ব্যাংকটিকে ৭৮ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হতে পারে।

আইটি কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ শতাংশ নগদ ও ২ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছিল। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে নগদ লভ্যাংশ ৬ শতাংশে নামে ও স্টক লভ্যাংশ ৪ শতাংশ হয়।

শেয়ার মালিকানার ওপর ভিত্তি করে বিগত বছরগুলোতে ব্যাংকটি জেনেক্স ইনফোসিস থেকে যে নগদ লভ্যাংশ পেয়েছে তা বিবেচনায় নিলে লোকসান ৭৫ কোটি টাকায় নেমে আসতে পারে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ নিজেই জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেখানে ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি চুপ ছিল!

বিশ্লেষকরা এই বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ আইটি কোম্পানিটির শেয়ারের পারফরম্যান্স কখনই খুব ভালো ছিল না, যে তারা তাদের মোট শেয়ারবাজারের বিনিয়োগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখানে বিনিয়োগ করতে পারে। তারা মনে করেন, ব্যাংকটি আমানতকারীদের অর্থ ব্যয় করে উচ্চ দামে শেয়ার কিনেছে। যাতে করে কারসাজিকারীদের শেয়ার বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছে।

এর আগে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর তদন্তে ধরা পড়ে যে, আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীরা ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে এই শেয়ারের দাম নিয়ে কারসাজি করেছেন।

ফলে মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে শেয়ারটির দাম ৬৯ শতাংশ বেড়ে যায়। সিরিয়াল ট্রেডিং হলো শেয়ারের দামকে প্রভাবিত করতে একই সুবিধাভোগী অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার কেনা ও বেচা।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আবুল খায়ের হিরু ও তার দুই সহযোগী ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের মাধ্যমে শেয়ারটির লেনদেন করেন।

২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ারের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করত। কিন্তু, ২০২১ সালে কারসাজির সময় এক লাফে দাম বেড়ে ১৭৫ টাকায় ওঠে।

যখন শেয়ারটির দাম ১৭০ টাকার বেশি হয়েছিল তখনই শেয়ারগুলো কিনে নেয় ইউসিবি। তবে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এর দাম আবার আগের ৫০ থেকে ৬০ টাকায় নেমে আসে। আর গতকাল শনিবার শেয়ারটি ৪০ টাকা দরে লেনদেন হয়েছে।

এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ারের দর যখন সর্বোচ্চ হয়েছিল তখন শেয়ারগুলো কিনেছিল ইউসিবি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, কারসাজির কারণে যখন কোনো শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে, তখন কারসাজিকারীরা দ্রুত শেয়ার বিক্রি করে দেন।

তিনি গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বেশি দামে বেশি সংখ্যক শেয়ার কিনতে পারে না। ফলে তখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

'এখানে ব্যাংকটি ডাম্পিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকটির কিছু লোক জড়িত থাকতে পারে, যারা কারসাজিকারীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য ব্যাংকটিকে শেয়ার কিনতে বাধ্য করেছিল,' বলেন তিনি।

তার ভাষ্য, এভাবে ব্যাংক, এনবিএফআই ও মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ অপব্যবহারের অনেক উদাহরণ আছে।

তিনি আরও বলেন, যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা বা পরিচালক শেয়ার কেনার সঙ্গে জড়িত থাকেন, সাধারণত তারা কারসাজিকারীদের লাভবান হতে গোপন চুক্তির মাধ্যমে সুবিধা দিয়ে থাকে।

তিনি মন্তব্য করেন, এতে ব্যাংকের অর্থ আটকে যায় ও লোকসানে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত শেয়ারবাজার তারল্য হারায়।

অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, 'এটা একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শীর্ষস্থানীয় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিনিয়োগের সব সিদ্ধান্ত যথাযথ গবেষণার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, 'যাচাইবাছাই করে শেয়ার কেনা হলে কেউ এত বেশি দামে ও এত বেশি শেয়ার কিনতে সমর্থন করতে পারে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, কাউকে সুবিধা দিতে এগুলো কেনা হয়েছিল।'

এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে জেনেক্স ইনফোসিসের মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ শতাংশ কমে ৩০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি শেষ হওয়া অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ২ টাকা ৫৪ পয়সা।

সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি আসিফ খান বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মূলত আমানতকারীদের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। আমানতকারীরা তাদের বিশ্বাস করে অর্থ রাখে। তাই ব্যাংকগুলোর বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই দায়িত্বের একটি অংশ হলো বিচক্ষণ বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা।

'মোট পোর্টফোলিও আকারের তুলনায় এই বিনিয়োগ বেশ বড় বলেই মনে হচ্ছে। তাই এখানে কিছু প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক,' বলেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদ নিয়েছে এবং তারা এটিকে 'কৌশলগত বিনিয়োগ' হিসেবে উল্লেখ করেছিল।'

তিনি আরও বলেন, সাধারণত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা থেকে বোর্ডে এই ধরনের প্রস্তাব পাঠানো হয়। তারপর তার ওপর ভিত্তি করে বোর্ড হয় প্রস্তাবটি অনুমোদন করে বা প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু ইউসিবির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং রীতিনীতি লঙ্ঘিত হয়েছে।

ইউসিবির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন, ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির প্রভাবে পরিচালনা পর্ষদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে ইউসিবির ট্রেজারি বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেনকে গত সপ্তাহে ডেইলি স্টার থেকে ফোন কল ও খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি।

আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus’ economic gambit paying off

Two months ago, as Professor Muhammad Yunus waded into Bangladesh’s unprecedented political turmoil, he inherited economic chaos by default.

5h ago