বেনাপোল বন্দরে ওজনে কারসাজি, ধরাছোঁয়ার বাইরে প্রতারকরা

বন্দর কর্তৃপক্ষ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৭ কর্মকর্তাকে বদলি করেছে। তবে, তাদের বিরুদ্ধে এখনও বিভাগীয় বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বেনাপোল স্থলবন্দরে ওজন সেতু স্কেলে আমদানি পণ্য বোঝাই একটি ট্রাক। ছবি: স্টার

বড় কেলেঙ্কারি ধরা পরার ছয় মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও বেনাপোল বন্দরের ওজন সেতু স্কেলে আমদানি পণ্যের ওজন কারসাজির ঘটনায় কাউকে অভিযুক্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর কর্তৃপক্ষ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৭ কর্মকর্তাকে বদলি করেছে। তবে, তাদের বিরুদ্ধে এখনও বিভাগীয় বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে হাজারো টন আমদানি পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। গত বছর এই বন্দর থেকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়।

সূত্র জানায়, শুধু গত বছরই ওজন কারসাজির মাধ্যমে প্রতারকরা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান চৌধুরী বিস্তারিত কিছু উল্লেখ না করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই জালিয়াতির পেছনে রয়েছে।'

বন্দর কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে জানতে পেরেছে যে কিছু বন্দর কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বন্দর সার্ভারে প্রবেশ করে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ত্রুটিগুলোকে কাজে লাগিয়ে প্রতারকরা এই কাজ করেছে। তবে, প্রতারকদের শনাক্ত করতে পারেনি তারা।

প্রতারণা

বন্দরের কার্যক্রমে গতি আনতে তিন বছর পাইলটিং করার পর ২০২০ সালে যখন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হয়, তখন থেকেই চলছে এই প্রতারণা।

কম্পিউটারাইজড সিস্টেমটি ওজন সেতুর স্কেলের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এটি আমদানিকৃত পণ্য বোঝাই ট্রাক বা লরির ওজন পরিমাপ করে।

গাড়ির ওজন বাদ দিয়ে পণ্যের নেট ওজন পরিমাপ করার পরে সফটওয়্যারটি সার্ভারে ডেটা সংরক্ষণ করে এবং শুল্ক হিসাবের জন্য ওজনের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিবেদন তৈরি করে।

নথি থেকে দেখা যায়, এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরপরই স্থলবন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তা, আমদানিকারক এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সমন্বয়ে তৈরি একটি সিন্ডিকেট সিস্টেমে কিছু ত্রুটি খুঁজে পায় এবং ওজনে কারচুপি শুরু করে।

এর ফলে আমদানিকারকরা শুল্ক পরিশোধ না করেই ঘোষণার বাইরে পণ্য আনতে সক্ষম হন এবং এই প্রক্রিয়ায় বিপুল অর্থ উপার্জন করেন।

দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে এই প্রতারণা দুইভাবে করা হয়েছিল। প্রথমে সিন্ডিকেট সদস্যরা ট্রাকগুলোকে ওজন সেতুর ৪, ৫ ও ৬ নম্বর স্কেলে ভুল অবস্থানে রেখে, এমনকি ট্রাক পরিবর্তন করে ওজনে কারসাজি করতো।

গত বছরের জুলাইয়ে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন এমন একজন আইটি বিশেষজ্ঞ জানান, যদি প্রতারকরা ওজন সেতুর স্কেলগুলোতে কাঙ্ক্ষিত ওজন না পায়, তখন সিন্ডিকেট সদস্যরা অ্যাডমিন আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ওজন পরিবর্তন করে দেয় এবং পরবর্তীতে যাতে এই বিষয়টি ধরা না পরে সেজন্য সফটওয়্যারের রেকর্ড থেকে পুরানো ওজনের ডেটা মুছে দেয়।

তিনি আরও জানান, অ্যাডমিন আইডি যাদের আছে তারা দূর থেকে 'এনি ডেস্ক' সফটওয়্যার ব্যবহার করে বন্দরে ব্যবহৃত কম্পিউটারের সফটওয়্যারে ডেটা পরিবর্তন করতো এবং ডিলিট করতো।

সিস্টেমের কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করে এই আইটি বিশেষজ্ঞ বলেন, সফটওয়্যারটিতে সাধারণ সুরক্ষা ব্যবস্থায় বেশি কিছু ত্রুটি রয়েছে।

তিনি বলেন, 'সফটওয়্যারটি একটি স্বতন্ত্র সার্ভার দিয়ে চালানো হয়, যা একটি বড় ত্রুটি। এখন সফটওয়্যারটির কোনো ডেটাবেজ লগ না থাকায় ডিলিট করা বা পরিবর্তন করা ডেটা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।'

যেভাবে ধরা পড়লো

গত ১২ জুলাই বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫ নম্বর ওজন সেতুতে একজন বহিরাগতকে দেখতে পান, যেখানে বেনাপোল বন্দরের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জাবেরী বিল্লাহ দায়িত্বে ছিলেন। বহিরাগত ওই ব্যক্তি জাবেরীর ইউজার আইডি ব্যবহার করছিলেন।

চার দিন পরে জাবেরী এ বিষয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে তার আইডি হ্যাক হয়েছে এবং কেউ এটি ওজনে কারসাজি করার জন্য ব্যবহার করছে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠনের জন্যও অনুরোধ করেন তিনি।

সূত্র জানায়, নিজেকে বাঁচাতে জাবেরী এই অভিযোগ দায়ের করেন।

গত ছয় মাসে বেনাপোল কাস্টমস একাধিকবার বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ৬০টি চালানের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এসব চালানের প্রতিটিরই দুটি করে ওজন প্রতিবেদন রয়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ ডেটাবেজের সব রেকর্ড সংরক্ষণসহ সফটওয়্যারের ত্রুটি ঠিক করেনি বলেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, কাস্টমস ও স্থলবন্দরের কর্মকর্তাদের একটি অংশ, আমদানিকারক এবং সিঅ্যাণ্ডএফ এজেন্টরা শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে অটোমেশন সিস্টেমের ত্রুটিগুলোকে কাজে লাগিয়ে।

বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার আব্দুল হাকিম বলেন, 'যেকোনো সফটওয়্যারের আদর্শ বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো ডেটা সার্ভারে সংরক্ষণ করা হলে তা ডিলিট করা যায় না। আইটি বিশেষজ্ঞরা সংরক্ষিত এই ডেটা থেকে সিস্টেমে কোনো ত্রুটি থাকলে বা কোনো ধরনের ম্যানিপুলেশন হয়ে থাকলে তা শনাক্ত করতে পারেন এবং দায়ী ব্যক্তিকে ধরতে পারেন।'

তিনি বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি যে বেনাপোল স্থলবন্দরের তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। তাই আমরা সফটওয়্যারটি পুনরায় কনফিগার ও সংশোধন করার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি।'

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) আক্তার উননেসা শিউলি এই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন। তিনি জানান, প্রতারকরা সফটওয়্যার থেকে তাদের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট মুছে ফেলায় তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, 'আমরা ওজন সেতুর স্কেলগুলোতে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছি এবং সিস্টেমটিকে ত্রুটিমুক্ত করতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছি।'

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান চৌধুরী জানান, তারা ইতোমধ্যে সরকারের আইসিটি বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছে ত্রুটিগুলো সমাধানের জন্য।

স্ক্যানার

বেনাপোল কাস্টমস এখন আমদানিকারক, সিঅ্যাণ্ডএফ এজেন্ট, অপারেটর, সুপারভাইজার এবং সফটওয়্যারে অ্যাডমিন লগইন অ্যাক্সেস রয়েছে এমন বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির ওপর আলাদাভাবে তদন্ত করছে।

বেনাপোল কাস্টমসের গোয়েন্দা ও তদন্ত শাখার গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে মো. হোসেন আলী ফয়জুল ও মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামসহ কয়েকজন বন্দর কর্মকর্তাকে ওজন কারসাজির মাধ্যমে নির্দিষ্ট শুল্ক ফাঁকির ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

জামালপুর স্থলবন্দরে নিয়োজিত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জাবেরী বিল্লাহ এবং বরখাস্তকৃত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আব্দুল কাদের জিলানীর আজ কমিটির সামনে হাজির হওয়ার কথা রয়েছে।

৪ নম্বর ওজন সেতু পরিচালনা করতেন জিলানী।

গত বছরের আগস্টে জিলানীকে একটি পৃথক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অপরাধে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আখাউড়া স্থলবন্দরে প্রায় ১১০০০ট গাড়ির তথ্য না লিখে বন্দরের ১২ লাখেরও বেশি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছিল।

৫ নম্বর ওজন সেতু পরিচালনা করতেন জাবেরী। একজন বহিরাগতের কাছে জাবেরীর আইডি ও পাসওয়ার্ড ছিল।

৬ নম্বর ওজন সেতুটি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড নামে পরিচিত। ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টরদের জন্য নির্ধারিত আইডি ছাড়াই এটি পরিচালনা করা হয়েছিল এবং এটি ব্যবহার করে বিশেষত পচনশীল পণ্যের ওজন কারসাজি করা হয়।

উদ্বোধনের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে এই স্কেলটি পরিচালনা করেছেন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ও সিবিএ সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সগীর, সিবিএ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, কামরুল হাসান পলাশ ও খোদা বক্স লিটন।

অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, বন্দর কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে যে বিল্লাহ হোসেন ও আনোয়ারুল নামে দুজন বহিরাগত ব্যক্তি স্কেল তিনটি পরিচালনা করেছেন।

ওজন কারসাজির ঘটনার সময় বন্দরের সব ওজন সেতুর স্কেল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মনিরুল ইসলাম। অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি কল কেটে দেন এবং এরপর আর কল রিসিভ করেননি।

বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক তদন্তে আরও জানা যায় যে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রোগ্রামার মো. আলী হোসেন ফয়জুল এবং ডাটাসফট সিস্টেমস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রকল্প সমন্বয়কারী শাহাদাত হোসেনের আইডি ব্যবহার করে ওজনে কারসাজি করা হয়েছিল।

তদন্ত কমিটির একজন সদস্য ছিলেন ফয়জুল নিজেও।

ঢাকায় বদলির আগে বেনাপোল স্থলবন্দরের অটোমেশন সিস্টেমের একমাত্র আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ফয়জুল।

ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর প্রত্যাহার করা হয় শাহাদাতকে।

রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শাহাদতের অ্যাডমিন আইডি ছিল বলে স্বীকার করলেও ওজনে কারসাজির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেছেন।

Comments