চট্টগ্রাম বন্দর: প্রাচীন খ্যাতি থেকে আধুনিকতার মুগ্ধতায়

ইউরোপীয়দের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের আদুরে নাম ছিল ‘পোর্তে গ্রান্দ্রে’ বা ‘গ্র্যান্ড পোর্ট’ যদিও এটি একটি পোতাশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হতো। ঐতিহাসিকদের কাছে চট্টলা বন্দিত হয়েছে ‘সৌন্দর্যের রানি’ হিসেবে।
চট্টগ্রাম বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

এক সময় প্রাকৃতিক বন্দর চট্টগ্রামের খ্যাতি প্রাচীন গ্রিসেও পৌঁছেছিল। সময়ের স্রোতে এই বন্দরের খ্যাতি ছড়িয়েছিল আবিষ্কৃত পৃথিবীর সব প্রান্তেই।

ইতিহাস বলছে—প্রাচীনকালেই চট্টগ্রাম বন্দর টেনেছিল আরব বণিকদের। এরপর পর্তুগিজ-ওলন্দাজসহ ইউরোপীয় বণিকরা তাদের জাহাজ নোঙর করেছিলেন এই বন্দরে।

ইউরোপীয়দের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের আদুরে নাম ছিল 'পোর্তে গ্রান্দ্রে' বা 'গ্র্যান্ড পোর্ট' যদিও এটি একটি পোতাশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হতো। ঐতিহাসিকদের কাছে চট্টলা বন্দিত হয়েছে 'সৌন্দর্যের রানি' হিসেবে।

১৮৮৮ সালে ব্রিটিশরা চিটাগাং পোর্ট কমিশনার্স অ্যাক্ট গঠন করলে এর মাধ্যমে এ বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর বন্দরের মূল অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলতে থাকে। সেসময় ইংরেজদের আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরকে মাথায় রেখে তৎকালীন পূর্ব বাংলার দক্ষিণপূর্ব অংশে রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে।

১৮৯৯ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরে স্থায়ী জেটি তৈরি করে। সেই বছরই জুনে এই জেটিতে প্রথম বাস্পচালিত জাহাজ 'স্যার রবার্ট ফার্নিক' ভিড়ে। পরবর্তী কয়েক বছরে সেই প্রতিষ্ঠানটি বন্দরে আরও তিনটি জেটি তৈরি করে।

চট্টগ্রাম বন্দর
সারি সারি ক্রেন সুবিশাল তোরণপথের আকার নিয়েছে। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

এখনকার চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালের ভেতরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেলেই দেখা যাবে যান্ত্রিক সভ্যতার এক বিস্ময়কর জগৎ। দেখা যাবে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর সারি সারি গ্যান্ট্রি ক্রেন আকাশের দিকে মুখ করে সুবিশাল তোরণপথের আকার নিয়েছে।

এই ক্রেনগুলো বিশাল বাহু দিয়ে আলতো করে জাহাজের ডেক থেকে তুলে আনছে কনটেইনারগুলো। এ দৃশ্য একটি আধুনিক বন্দরের মুগ্ধতার কথা মনে জাগিয়ে দেয়।

যদি জোয়ারের সময় আসেন তাহলে দেখতে পাবেন বিশাল আকৃতির জাহাজের তীরে আসার অপূর্ব দৃশ্য। বন্দরের ১৩ কনটেইনার জেটির বেশিরভাগই দিনরাত ব্যস্ত থাকে। এখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় আট হাজার টিইইউ কন্টেইনার উঠানো-নামানো হয়।

আপনি যদি জেটি থেকে আপাতদৃষ্টিতে বিস্তৃত স্টোরেজ ইয়ার্ডের দিকে তাকান তাহলে মনে হবে এখানকার পণ্যবাহী গাড়ি, ফর্কলিফ্ট, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রিচ স্ট্যাকার ও পণ্য উঠা-নামার অন্যান্য সরঞ্জামের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কতই না সহজ।

বন্দরের ইয়ার্ডগুলোয় প্রায়ই ৪০ হাজার একক (টিইইউ) কনটেইনার মজুদ থাকে। এর মধ্যে প্রতিদিন বন্দর থেকে পাঁচ হাজার টিইইউ কনটেইনারের বেশি পণ্য খালাস করা হয়।

বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বার্ষিক ১২৫ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের ৬৭তম ব্যস্ততম কন্টেইনার বন্দর। ২০২২ সালে এ বন্দর দিয়ে ৩১ লাখ ৪০ হাজার টিইইউ কন্টেইনার পরিচালনা করা হয়।

কিন্তু পাঁচ দশক আগেও চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন ছিল। তখন এখানে কনটেইনারবাহী পণ্য পরিচালনার মতো অবস্থা ছিল না। ১৯৭৭ সালের ২২ মার্চ বন্দরের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিন প্রথম ছয় টিইইউ কনটেইনার নিয়ে ছোট জাহাজ 'এসএস টেনাসিটি' বন্দরে নোঙর করে।

চট্টগ্রাম বন্দর
১৮৮৮ সালে ব্রিটিশরা চিটাগাং পোর্ট কমিশনার্স অ্যাক্ট গঠন করলে এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

১৯৭০ এর দশকে পাঁচ বা ছয়টি ক্রেন ছিল। প্রতিটি ক্রেন মাত্র তিন টন ওজনের পণ্য বহন করতে পারতো। এখন ১৮টি বিশাল আকৃতির গ্যান্ট্রি ক্রেনের প্রতিটিই ঝামেলা ছাড়াই ৪০ টন ওজনের কন্টেইনার তুলতে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত কয়েক দশকে চট্টগ্রাম বন্দরের আমূল পরিবর্তন হয়েছে।'

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এ বন্দরের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে পুরাতন জেটিগুলোর সংস্কার শুরু হয়।

১৯৭০-র দশকের শেষের দিকে তৈরি পোশাক বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়। সেসময় কনটেইনারের ব্যবহার সারাবিশ্বে জনপ্রিয় হয়। পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও পোশাক রপ্তানিতে কনটেইনারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ১৯৮০-র দশক থেকে বন্দরে কনটেইন্টার পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

১৯৮৬ সালে বন্দরে তৈরি হয় প্রথম কনটেইনার টার্মিনাল। চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল নামের এই টার্মিনালে আছে দুইটি ডেডিকেটেড কন্টেইনার জেটি। কিন্তু, এখানে কোয়েসাইড গ্যান্ট্রি ক্রেনের মতো প্রয়োজনীয় কন্টেইনার উঠানো-নামানোর সরঞ্জাম যোগ করতে দুই দশকেরও বেশি সময় লেগে যায়।

২০০৫ সালে এই টার্মিনালে প্রথম চারটি গ্যান্ট্রি ক্রেন বসানো হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর
১৯৭৭ সালে ছয় টিইইউ কনটেইনার পরিচালনার পর ২০০৮ সালে তা বেড়ে ১০ লাখে দাঁড়ায়। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

কনটেইনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি টার্মিনাল তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। অবশেষে ২০০৭ সালে পাঁচটি কন্টেইনার জেটিসহ নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) কাজ শেষ হয়।

তবে, বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে ও প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জাম স্থাপনে দেরি হওয়ায় আট বছর এই নতুন টার্মিনাল পুরোদমে কাজ করতে পারেনি।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ এম আরিফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওই সময় কনটেইনার পরিবহন অনেক বেড়ে গেলেও যথাযথ সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ব্যবসায়ীরা কনটেইনার জটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন।'

১৯৭৭ সালে মাত্র ছয় টিইইউ কনটেইনার পরিচালনার পর ২০০৮ সালে তা বেড়ে ১০ লাখে পৌঁছায়। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে হয় ২০ লাখ টিইইউ। ২০১৯ সালে বন্দরটি ৩০ লাখ টিইইউ কনটেইনার পরিচালনার মাইলফলক স্পর্শ করে।

২০১২ সাল থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ সাধারণ কার্গো বার্থের (জিসিবি) একটি অংশ কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল নামে বহুমুখী টার্মিনালে রূপান্তর, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, লালদিয়া বহুমুখী টার্মিনাল ও বে টার্মিনাল—এই চারটি বন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে আলেচনা শুরু হয়। জিসিবি রূপান্তর পরিকল্পনাটি পরে বাতিল হয়। বাকি প্রকল্পগুলো দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে যায়।

২০১৩ সালে মন্ত্রিসভা কমিটি লালদিয়া প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। ২০১৫ সালের মধ্যে এর উন্নয়ন কাজ শুরুর প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু, প্রকল্প এলাকায় অবৈধ স্থাপনা থাকায় তা বেশ কয়েক বছর এগোয়ানি। সম্প্রতি শীর্ষ ডেনিশ শিপিং প্রতিষ্ঠান মায়ের্স্ক গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান টার্মিনাল তৈরির প্রস্তাব দেওয়ায় সরকার নতুন করে আলোচনা শুরু করে।

চট্টগ্রাম বন্দর
২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৩০ লাখ টিইইউ কনটেইনার পরিচালনার মাইলফলক স্পর্শ করে। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পতেঙ্গা টার্মিনালের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল। করোনা মহামারি ও অন্যান্য কারণে শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের জুনে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়।

গত ডিসেম্বরে বন্দর কর্তৃপক্ষ সৌদি প্রতিষ্ঠান আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে পতেঙ্গা টার্মিনালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যুক্ত করাসহ তা পরিচালনার চুক্তিতে পৌঁছালেও গ্যান্ট্রি ক্রেন স্থাপনে আরও দুই বছর সময় লেগে যেতে পারে।

তিনটি টার্মিনাল নিয়ে গঠিত বে টার্মিনাল প্রকল্পটিও শুরু হতেও দেরি হয়। ২০২১ সালের আগস্টে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে তিনটি টার্মিনালের প্রথমটির কাজ ২০২৪ সালের মধ্যে প্রথমটির কাজ শেষ হবে। অথচ এখনো কাজই শুরু হয়নি।

তবে এত দেরির পর মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও লোহিত সাগরে অচলাবস্থার কারণে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য মন্দা হওয়া সত্ত্বেও বন্দরটি খুব বেশি অচলাবস্থায় পড়েনি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যমান অর্থনৈতিক মন্দা বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। মন্দার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য কিছুটা কমে আসায় এই প্রকল্পগুলো কিছুটা সময় পেল।'

তিনি প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করার ও সময়মতো সেগুলো চালুর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন যাতে আগামীতে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

তবে চবক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল দাবি করেন, সম্প্রতি সব প্রকল্পই গতি পেয়েছে এবং সেগুলোর কাজের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

এ বছরই বড় ধরনের উন্নয়ন কাজ শুরুর কথা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'বে টার্মিনালের অধীনে তিনটি টার্মিনালের একটি তৈরির কাজ চলতি বছরের মাঝামাঝি শুরু হবে।'

Comments