এস আলম গ্রুপের ‘অর্থনৈতিক আগ্রাসন’ জেনেও সবাই নীরব ছিল

এস আলম গ্রুপ অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে একটি ব্যাংকের টাকা দিয়ে আরেকটি ব্যাংক কিনেছে। এখন এসব তথ্য বের হয়ে আসছে। কিন্তু ব্যাংকিংখাত সংশ্লিষ্টরা, ব্যাংকিং মহলে, দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে অনেকের বিষয়টি জানা ছিল।’

এস আলম গ্রুপ অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে একটি ব্যাংকের টাকা দিয়ে আরেকটি ব্যাংক কিনেছে। এখন এসব তথ্য বের হয়ে আসছে। কিন্তু ব্যাংকিংখাত সংশ্লিষ্টরা, ব্যাংকিং মহলে, দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে অনেকের বিষয়টি জানা ছিল।'

দেশের কয়েকটি ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের নেওয়া ঋণের বিষয়ে আলাপকালে গতকাল সোমবার দুপুরে দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।

একটি গ্রুপের এত বেশি ঋণ নেওয়া এবং একাধিক ব্যাংক একটি গ্রুপের পরিচালনায় থাকা দেশের ব্যাংকিংখাত ও অর্থনৈতিকখাতের জন্য উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে তৎকালীন গভর্নরসহ আরও ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য নিয়ে একটি মনিটরি পলিসি মিটিং হচ্ছিল। সেখানে বলেছিলাম, এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, সেইসঙ্গে তারা এতগুলো ব্যাংকের মালিকানায় আছে। এটা তো ব্যাংকিং খাতের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। গভর্নর শুনে নীরব থেকেছেন। এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।'

'সেই সময় তৎকালীন গভর্নরকে মজা করে বলেছিলাম, এস আলম গ্রুপের মালিকের সঙ্গে একটি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক রাখার ব্যবস্থা করেন। যাতে তিনি কোনো কারণে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায়, তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। নইলে তিনি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যাংকিংখাত ধসে যাবে। একজন মানুষের কার্যক্রমে পুরো দেশের ব্যাংকিংখাত ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে,' যোগ করেন তিনি।

কয়েকটি ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের নেওয়া ঋণের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, 'এস আলম গ্রুপের ৩০ হাজার কোটি টাকা, ৮০ হাজার কোটি টাকা বা ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষ এখন জানতে পারছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়েরও বিষয়টি আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু সবাই চুপ থেকেছে। কেউ তার দায়িত্ব পালন করেনি।'

ব্র্যাক ব্যাংকের ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, '২০১৯ বা এর কাছাকাছি সময়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কিছু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এসেছে, এস আলম গ্রুপ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে একাধিক হোটেল কিনেছে দেশটিতে। বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, সিঙ্গাপুরে গ্রুপটির ৩টি হোটেল আছে এবং সপ্তাহ দুয়েক আগেই তারা সিঙ্গাপুরের হায়াত হোটেলটি কিনে নিয়েছে। সিঙ্গাপুরে তাদের শপিংমল থাকার কথাও শোনা যায়। সিঙ্গাপুরে তাদের যে হোটেল ও শপিংমল আছে, তার মূল্যমান হবে কয়েকশ মিলিয়ন ডলার।'

তিনি বলেন, 'এই যে তথ্যগুলো জানা গেল বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসল, তখনই তো বিষয়টি তদন্তের আওতায় আনা দরকার ছিল। বাংলাদেশের জানা দরকার ছিল, এই তথ্যগুলো সত্য না অসত্য। বাংলাদেশ থেকে বৈধ উপায়ে বিদেশে টাকা নেওয়ার সুযোগ তো ছিল না। তাহলে একেকটি হোটেল কিনতে যে অন্তত ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার লাগে, সেটা তারা সিঙ্গাপুরে কীভাবে পেল? এই বিষয়গুলো তদন্ত করলেই বের হয়ে আসত। তখন তদন্ত করা হয়নি। কিন্তু এখন তো তদন্ত করা অপরিহার্য। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশন— উভয়েরই এ বিষয়ে তদন্ত করা উচিত।'

সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ইসলামী ব্যাংক বলেছে, তাদের ব্যাংক কোনো বেনামি ঋণ দেয়নি এবং সব ঋণ দেওয়া হয়েছে নিয়ম মেনে। এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করে এ বিষয়ের সত্যতা বের করে আনা উচিত। ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কোনো তথ্য-বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য নয়।'

'যখন থেকে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠছিল, তখনই সরকারের উচিত ছিল এগুলো তদন্ত করা। বিষয়টি যে অবস্থানে পৌঁছে গেছে, সরকারকে এখনই এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ তদন্ত এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেরি করার আর বিন্দুমাত্র সময় নেই', বলেন এ অর্থনীতিবিদ।

Comments