প্রশ্নবিদ্ধ বিনিয়োগে আইসিবির ৪৩৮ কোটি টাকা লোকসানের আশংকা

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিনিয়োগ সংস্থার (আইসিবি) কিছু অস্বাভাবিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে করদাতাদের ওপর ৪৩৮ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা চাপতে পারে। একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, এই তহবিল অনাদায়ী হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিনিয়োগ সংস্থার (আইসিবি)  লোগো। ছবি: আইসিবির ওয়েব সাইট থেকে সংগৃহীত
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিনিয়োগ সংস্থার (আইসিবি) লোগো। ছবি: আইসিবির ওয়েব সাইট থেকে সংগৃহীত

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিনিয়োগ সংস্থার (আইসিবি) কিছু 'অস্বাভাবিক' ও প্রশ্নবিদ্ধ বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে করদাতাদের ওপর ৪৩৮ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা চাপতে পারে। একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, এই তহবিল অনাদায়ী হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের একটি নিরীক্ষায় জানা গেছে, ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা পদ্মা ব্যাংকে অস্বাভাবিক বিনিয়োগের কারণে আইসিবির ১৭৪ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে। 

দেশের সর্বোচ্চ এই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০১৫-১৬ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আইসিবির কার্যক্রমের ওপর এই নিরীক্ষা করেছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আইসিবি শেয়ার কেনা বাবদ পদ্মা ব্যাংকে ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এ ক্ষেত্রে ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর প্রতিটি শেয়ার ১৩ দশমিক ৩৩ টাকায় কেনা হয়।

পদ্মা ব্যাংক এখনো পুঁজিবাজারে প্রবেশ করেনি এবং এই ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ফলে আইসিবির এই বিনিয়োগ এখনো কোনো কাজে আসেনি।

এছাড়াও, একই ব্যাংকে আইসিবি ১৯৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকার একটি ফিক্সড-ডিপোজিট খোলে। এটি ম্যাচিউর হওয়ার পর কিছু তহবিল ফিরিয়ে দেওয়া হলেও আইসিবি এখনো ১১৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে, যার মধ্যে ৬ দশমিক ৮৬ কোটি টাকার সুদ অন্তর্ভুক্ত।

আইসিবির বিনিয়োগ অনুমোদনের চিঠিতে শর্ত দেওয়া হয়, কার্যক্রম শুরুর ৩ বছরের মধ্যে পদ্মা ব্যাংক পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের মতে, পদ্মা ব্যাংকের দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আইসিবির ১৭৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

আইসিবি আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু কিছু বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক ছিল না এবং এগুলোর পেছনে কোনো সুষ্ঠু বিশ্লেষণী প্রক্রিয়াও অবলম্বন করা হয়নি বলে অভিযোগ এসেছে। মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের মতে, ২৬৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ তহবিল চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।

২০১৮ সালে আইসিবি ঢাকার লে মেরিডিয়ান হোটেলের সত্ত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান বেস্ট হোল্ডিংস এর ১৫০ কোটি টাকার কনভার্টিবল সিকিউরড বন্ড কেনে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে বন্ড ম্যাচিউর হলেও আইসিবি এখনও মূলধন ও ৪ কোটি টাকা সুদ বুঝে পায়নি।

আইসিবির ভুল বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের আরেকটি উদাহরণ হল ২০১৩ সালে গ্লোবাল জুট ইন্ডাস্ট্রিজের ২৫ কোটি টাকার ডিবেঞ্চার ক্রয়।

পাট উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানটি এখনও এই ঋণ পরিশোধ করেনি, যার ফলে আইসিবি এর পুনঃতফশিল করেছে।

বর্তমানে এই তহবিল ৩৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। আইসিবি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাচ্ছে না।

১৯৭৬ সালে আইসিবির কার্যক্রম শুরু হয়। এই সংস্থা বাংলাদেশের পূঁজিবাজারকে সহায়তা করে থাকে।

সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আইসিবির মুনাফা ছিল ৪১৬ কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছরে এটি ৬৫ শতাংশ কমে ১৪৪ কোটি হয়।

একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, আইসিবির কিছু ভুল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির লাভ ও উপযোগিতা কমিয়েছে।

ভোলার সোনাইছড়ি অ্যাগ্রো ফার্মস আইসিবি থেকে একটি প্রকল্পের জন্য ৯১ লাখ টাকা ঋণ নেয়। তবে বাস্তবে এ ধরনের কোনো প্রকল্পের অস্তিত্বই নেই।

নিরীক্ষক জানান, প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি সুরক্ষিত নয়। ফলে এটি বাস্তবায়নযোগ্য ছিল না। যে কারণে বরাদ্দকৃত তহবিল অন্য খাতে খরচ করা হয়।

আইসিবি ডিপ ওশ্যান বায়োপ্ল্যান্ট নামের একটি ভুয়া প্রকল্পে ১ দশমিক ২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। নিবন্ধনকৃত জায়গায় কোনো মাছ চাষ প্রকল্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিলের (ইইএফ) মাধ্যমে করা বিনিয়োগগুলো থেকেও কোনো উপকার পায়নি আইসিবি।

আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, 'আইসিবি ফার্মার্স ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিল এই আশায় যে, ব্যাংকের পারফরম্যান্স আরও ভালো হবে এবং ভালো লভ্যাংশ পাওয়া যাবে। তবে ব্যাংকটির পারফরম্যান্স আশানরূপ ছিল না।'

ফার্মার্স ব্যাংকের এফডিআর প্রসঙ্গে আবুল হোসেন জানান, তারা বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর রাখেন। তিনি বলেন, 'হয়তো, তৎকালীন কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন এই ব্যাংকটি সম্ভাবনাময়।'

গত ২ বছরে ব্যাংকটি এফডিআরের বিপরীতে কিছু সুদ দেওয়া শুরু করেছে।

আবুল হোসেন আরও জানান, বেস্ট হোল্ডিংস আরও কিছু সময় চেয়েছে এবং জানিয়েছে খুব শিগগির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তারা তহবিল পাবে। আইসিবি ২০২৪ পর্যন্ত অর্থ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়েছে।

ইইএফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মূল সমস্যা শেষ কিস্তি নিয়ে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ইইএফ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি'।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, আইসিবি'র শুধু বিভাগীয় শাখা রয়েছে। এ কারণে ইউনিয়ন পর্যায়ে বিনিয়োগের তদারকি করা খুব ঝামেলাপূর্ণ।

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন ICB could lose Tk 438cr for unusual investment decisions

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments