ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের খেলাপি প্রায় দ্বিগুণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের ৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৭০ কোটি টাকায়।
করোনা মহামারি, ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণ, এমএফআই, খেলাপি ঋণ,

করোনা মহামারি ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআই) খেলাপি ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের ৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৭০ কোটি টাকায়।

২০২১-২২ অর্থবছরে খেলাপি ঋণের অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এটি আগের অর্থবছরে ছিল ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এই সংখ্যাটি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭২ শতাংশের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরি মনে করেন, উচ্চ খেলাপির জন্য করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট দায়ী।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, যুদ্ধ এমন এক সময়ে এসেছে যখন ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা মহামারির ধকল কাটানোর চেষ্টা করছেন।

'সংকটের কারণে ঋণগ্রহীতারা সময়মতো তাদের প্রকল্প শেষ করতে পারেননি, বা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ফলে, তারা ঋণ পরিশোধে দেরি করতে বাধ্য হয়েছেন।'

'ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি নন' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মুজেরি ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে তিনি সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক ছিলেন।

তিনি বলেন, 'ব্যাংকিং খাতে আমরা যে ঋণগ্রহীতাদের দেখতে পাই ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা তাদের মতো নন। ব্যাংকিং খাতে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হন।'

তিনি আরও বলেন, 'ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধে দেরি করেন না। কারণ, তাদের আবার ঋণ নিতে হয়। এ ছাড়াও, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সারা বছর বিষয়টি তদারকি করে।'

তিনি মনে করেন, 'অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাদেরকে খেলাপি করেছে। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে তারা ঋণ পরিশোধ শুরু করবেন।'

২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৭৩৯ নিবন্ধনপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান ছিল। সেগুলোর মাধ্যমে ৩ কোটি ৮২ লাখ ব্যক্তিকে আর্থিক সেবা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই নারী।

২০২১-২২ অর্থবছরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয় ১৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।

দেশের অন্যতম বৃহৎ ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ প্রতিষ্ঠান বুরো বাংলাদেশের পরিচালক (অর্থ) মোশাররফ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মহামারির সময় প্রায় সব ক্ষুদ্র ঋণ বিরতরণকারী প্রতিষ্ঠান ৩ মাস তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখায় অনেক ঋণই অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।'

'মহামারির কারণে ঋণগ্রহীতাদের বিক্রি কমে যায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হওয়ার পর তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পুনঃঋণ পাননি।'

মোশাররফ হোসেনের মতে, মহামারির সময় ঋণ পর্যবেক্ষণ শিথিল করা হয়েছিল। এর ফলে খেলাপির হার বেড়েছে।

তার মতে, ২০২৩ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

'আমরা যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ কাজে লাগাতে পারি, তাহলে তা এ খাতের জন্য লাভজনক হবে,' যোগ করেন তিনি।

তবে, ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় জামানতসহ কঠোর শর্ত আরোপ করছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এটি আমাদের এই প্রণোদনাকে সবার জন্য কার্যকর হয়ে উঠতে বাধা দিচ্ছে।'

অপর শীর্ষ ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান আশা বাংলাদেশের মুখপাত্র হাবিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অপরিশোধিত ঋণ বাড়লেও মোট ঋণের তুলনায় তা এখনো কম।'

আশা বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা মোট তহবিলের প্রায় ৩ শতাংশ। এ খাতের গড় ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

এই হার ব্যাংকিং খাতের তুলনায় অনেক কম ছিল। মার্চের শেষে খেলাপির অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।

ক্ষুদ্রঋণ খাতে খেলাপি বেড়েছে মূলত জীবনযাত্রার উচ্চব্যয়ের কারণে।

হাবিবুর রহমান আরও বলেন, 'যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখন ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধে সমস্যায় পড়েন।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণ না থাকায় সূচক আরও বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ক্ষুদ্রঋণ বিরতণকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হাওর এলাকায় বন্যার নেতিবাচক প্রভাব ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের ওপরও পড়েছে।'

Comments