গত মে-সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে: এফএও

জাতিসংঘের এই সংস্থাটির গ্লোবাল ইনফরমেশন অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম অন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার কান্ট্রি ব্রিফ অনুসারে, গত মার্চ-এপ্রিল চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৯ লাখ।
খাদ্য নিরাপত্তা
খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম এলাকায় কম দামে টিসিবির পণ্য কেনার লাইন। ছবি: হাবিবুর রহমান/ স্টার ফাইল ফটো

২০২২ ও ২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও গত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে।

গত শুক্রবার খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

জাতিসংঘের এই সংস্থাটির গ্লোবাল ইনফরমেশন অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম অন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার কান্ট্রি ব্রিফ অনুসারে, গত মার্চ-এপ্রিল চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৯ লাখ।

তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলতে এমন পরিস্থিতিকে বোঝায় যখন কোনো ব্যক্তির পর্যাপ্ত খাবার কেনার সামর্থ্য থাকে না।

২০২২ ও ২০২৩ সালে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন চার বছরের গড় ছয় কোটি নয় লাখ টন হলেও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে।

গত বছর বাংলাদেশে চালসহ ছয় কোটি ৩৪ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছে। ধান ও ভুট্টার ফলন ভালো হওয়ায় চলতি বছর ছয় কোটি ৪২ লাখ টন শস্য উৎপাদনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এটি আগের বছরের তুলনায় এক দশমিক দুই শতাংশ বেশি।

২০২৩ সালে ধানের উৎপাদন বেড়ে রেকর্ড পাঁচ কোটি ৮৫ লাখ টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত বছরের উৎপাদনের তুলনায় তা এক দশমিক দুই শতাংশ বেশি।

এফএও'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফলন ভালো হওয়ায় বাজারে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা বেড়েছে। তবে ক্রমাগত উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে 'সবার খাবারের প্রাপ্যতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে'। খাবারের দাম বেশি হওয়ায় কম আয়ের মানুষদের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, গত সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও তা অক্টোবরে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়। এটি ২০১২-১৩ সালের পর সর্বোচ্চ।

গত জুনে মোটা চালের গড় খুচরা দাম ছিল প্রতি কেজি রেকর্ড ৫০ টাকা। এফএও'র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাইয়ে এর দাম কিছুটা কমেছে।

তবে গত এক মাসে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।

গত রোববার ঢাকায় এক কেজি মোটা চাল কিনতে ক্রেতাদের গড়ে ৫০ টাকা দিতে হয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, এক মাস আগের তুলনায় এই দাম দুই শতাংশ বেশি।

এফএও'র প্রতিবেদনে বলা হয়, 'উৎপাদন ও পরিবহনের খরচ বেশি হওয়ায় খাদ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর ফলে দেশে উত্পাদিত ফসলও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।'

এতে আরও বলা হয়, 'খাদ্যশস্য বিশেষ করে গম আমদানি কম হওয়ার পাশাপাশি টাকার দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যায়।'

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।

এফএও বলছে, মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছেন। তাদের বেশিরভাগই কক্সবাজারে শিবিরগুলোয় আছেন। তারা পুরোপুরি মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

জাতিসংঘের এই সংস্থাটি আরও বলেছে, বাংলাদেশের খাদ্যশস্য আমদানির বেশিরভাগই গম। দেশে গমের চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। এ ছাড়াও, কিছু পরিমাণ চাল ও ভুট্টাও আমদানি করা হয়।

গত জুনে শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছিল ৮০ লাখ টনের নিচে। এটি গত চার বছরের গড় ৮৬ লাখ টন আমদানির তুলনায় কম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ডলার সংকট ও টাকার উল্লেখযোগ্য অবমূল্যায়নের কারণে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য আমদানি কমানো হয়েছে।

'যেহেতু টাকার মান দুর্বল হচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কম, তাই ২০২৩-২৪ সালে আমদানির প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি পূরণ করতে দেশটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে।'

এফএওর পূর্বাভাসে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের বার্ষিক খাদ্যশস্য আমদানির প্রয়োজনীয়তা গড় আমদানির তুলনায় কিছুটা কমতে পারে।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে চাল আমদানি আড়াই লাখ টন ও গম আমদানি প্রায় গড়ে ৬১ লাখ টন হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

ভুট্টার ক্ষেত্রে এফএও'র পূর্বাভাস হলো—এর আমদানি গড়ে ২১ লাখ টনের বেশি হবে। এটি গবাদি পশু ও মাছের খাবারের জন্য প্রয়োজন।

খাদ্যশস্য উৎপাদন

দেশে ধানের বার্ষিক উৎপাদনের ৩৫ শতাংশ আসে আমন থেকে। এখন আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে এবং তা চলবে আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত।

এফএও'র প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আগস্টে ভারী বৃষ্টি ও বন্যার কারণে চট্টগ্রাম বিভাগে ফসলের ক্ষতি হলেও প্রত্যাশিত বাম্পার ফলনের ফলে উৎপাদন গড়ের তুলনায় বেশি হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

দেশের ধান উৎপাদনের ৫৫ ও ১০ শতাংশ আসে বোরো ও আউশ থেকে। এসব ধান কাটা শেষ হয়েছে।

বোরোর উৎপাদন রেকর্ড তিন কোটি ১১ লাখ টন ধরা হয়েছিল। নতুন নতুন এলাকায় ধান চাষ ও ধানের বাম্পার ফলনের ফলে এই রেকর্ড হয়েছে। আউশের গড় উৎপাদনের তুলনায় এবারের উৎপাদন কম বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এফএও জানিয়েছে, ২০২৩ সালে ভুট্টার উৎপাদন রেকর্ড ৪৭ লাখ টন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 'অনুকূল আবহাওয়া ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যাপক ব্যবহার করায় ভুট্টার উৎপাদন গড় উৎপাদনের তুলনায় বেশি হচ্ছে।'

গত এপ্রিলে ফসল কাটার পর দেশে গমের উৎপাদন সরকারিভাবে প্রায় ১১ লাখ টন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Comments