নতুন ঋণের জন্য বেইজিংয়ের দিকে তাকিয়ে ঢাকা

'প্রকল্পগুলো নিয়ে চীনের সঙ্গে সরকারের আলোচনা চলছে। তবে এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি'

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন বেইজিং সফরে চীনের ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ঋণ ছাড়াও প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চাইতে পারে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে চার বছরের জন্য দুই হাজার কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অর্থের দিক দিয়ে যা ছিল দ্বিপাক্ষিক অংশীদারির প্রতিশ্রুত হিসেবে সবচেয়ে বড় পরিমাণ।

বাংলাদেশ এমন এক সময়ে চীনা অর্থায়নের প্রত্যাশা করছে, যখন পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখার চাপের মুখে আছে দেশটি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮-১১ জুলাই চীনে সফর করতে পারেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বড় প্রকল্পের প্রস্তাব পেয়েছেন, যেখানে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পগুলো নিয়ে চীনের সঙ্গে সরকারের আলোচনা চলছে। তবে এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।

চীনা অর্থায়নে বিবেচনাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি হলো বরিশাল ও পায়রা বন্দর হয়ে ভাঙ্গা-কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ। এতে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে এমআরটি লাইন-২, যা গুলিস্তান হয়ে গাবতলী-নারায়ণগঞ্জ গুলিস্তান পর্যন্ত থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যাবে। এর মধ্যে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট একটি ব্রাঞ্চ লাইন থাকবে।

আন্ডারগ্রাউন্ড এবং এলিভেটেড মেট্রো রেলের খরচ প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

এ ছাড়া এরইমধ্যে বাণিজ্য সুবিধায় চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ৩ হাজার ৬০০ কোটি ইউয়ানের বেশি সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ।

বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ৫ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণ পাওয়া গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চলমান চাপ কমাতে এটি সাহায্য করবে।

ইআরডি কর্মকর্তা বলেন, পলিসি ঋণের বিষয়ে তারা চীনের সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় একটি চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।

চীন যদিও ২০১৬ সালে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবে এই বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দুই পক্ষ মাত্র নয়টি প্রকল্পে চুক্তি স্বাক্ষর করতে পেরেছে। ইআরডির তথ্য অনুসারে, যার পরিমাণ ৮ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার।

৮ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র ৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার ব্যবহার করতে পারবে। যা চীনের প্রতিশ্রুত অর্থের এক চতুর্থাংশেরও কম।

ঋণ বিতরণে ধীরগতির জন্য উভয় পক্ষের লালফিতার দৌড়াত্ম অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।

ইআরডির ওই কর্মকর্তা বলেন, এবার ২০১৬ সালের যে ঋণচুক্তির হয়েছিল তার চেয়ে ভিন্ন মডেলে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চীন ২০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর প্রজেক্ট বাই প্রজেক্ট আলাদা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল।

এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে ঋণচুক্তি সই হবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট যা ঘোষণা করেছেন তা ছিল প্রতিশ্রুতি।

তিনি মনে করেন, উভয় পক্ষের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ধীর অগ্রগতি এবং স্বল্প তহবিল বিতরণের জন্য দায়ী।

ইআরডির সাবেক সচিব কাজী শফিকুল আজম বলেন, উভয় পক্ষেরই কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যার কারণে ঋণ-চুক্তি চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'দুই দেশকেই কিছু আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলতে হয় এবং কখনো কখনো তা সময়সাপেক্ষ। একটি প্রকল্পের দেরির পেছনে এটিই মূল কারণ।'

২৭ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা

প্রতিশ্রুত ২০ বিলিয়ন ডলারে ২৭টি প্রকল্পে অর্থায়ন করার কথা ছিল। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ডিজিটাল সংযোগ প্রকল্প এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ইনফো সরকার-৩ নামে ৩৮৮ মিলিয়ন ডলারের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।

আরও সাতটি প্রকল্প পেয়েছে ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার এবং তাদের বাস্তবায়ন চলমান আছে।

৭০৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রকল্পের আওতায় নির্মিত কর্ণফুলী টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

৫৫০ মিলিয়ন ডলারের ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পসহ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং এবং ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প প্রায় শেষের দিকে।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ (১.৪ বিলিয়ন ডলার), পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক প্রকল্প (৯৭৭ মিলিয়ন ডলার), ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প (১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার) এবং রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রকল্প (২৭৬ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার) বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।

দুটি প্রকল্পের জন্য ঋণের আবেদন পাঠানো হয়েছে। চলতি বছরেই ৪৭৩ দশমিক  ৭৫ মিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল সংযোগ স্থাপনের ঋণচুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আখাউড়া-সিলেট রেললাইন মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরে বাণিজ্যিক চুক্তির জন্য আলোচনা চলছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার এবং ৩৫৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মোংলা বন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন প্রকল্প।

চীনের পক্ষ থেকে চারটি প্রকল্প মূল্যায়ন করা হচ্ছে-- চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চল (২২১ মিলিয়ন ডলার), জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনের সমান্তরালে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ (৯০২ মিলিয়ন ডলার), ছোট আকারের পৌরসভার জন্য পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, নিষ্কাশন এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ২২৯ মিলিয়ন ডলার) এবং ঢাকা শহরের দশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ক্যাচমেন্টের আওতায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ (১৯৮ মিলিয়ন ডলার)।

Comments