কে বহন করবে এই সংকটের ক্ষতি?

কারফিউ, সহিংসতা, কোটা সংস্কার আন্দোলন, মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ,
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত সপ্তাহে সহিংসতা চলাকালে ঢাকার একটি সড়কের দৃশ্য। ছবি: স্টার

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সহিংসতা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ মাসের মাঝামাঝিতে ছড়িয়ে পড়া এই সহিংসতায় অনেক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে এবং তার বেশিরভাগই পুলিশের গুলিতে। পাশাপাশি চাপে থাকা দেশের অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলেছে। তাই অর্থনীতিবিদরা এই সংকটকে দেশের জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছেন।

সাধারণত যে কোনো সহিংসতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থাকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাত। কারণ এটি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ব্যাহত করে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে এবং মানুষের উৎপাদনশীলতা কমায়।

সংকটের প্রেক্ষাপট হলো, এ মাসের মাঝামাঝিতে দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৮ জুলাই রাত থেকে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয় এবং দেশব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়।

সহিংসতা চলাকালে অনেকে নিহত হয়েছেন। অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে পড়ার আশঙ্কায় আছেন। শুধু তাই নয়, সহিংসতা চলাকালে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

তবে দেশব্যাপী কারফিউ জারির পর সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে এলেও এ ঘটনা দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি করে।

এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় মানুষ ব্যাংক হিসাবে ঢুকতে ও লেনদেন করতে পারেনি। পাশাপাশি বাসা কিংবা অফিসের গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে পারেনি অনেকে।

সবমিলিয়ে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষ প্রয়োজনে অতিরিক্ত পণ্য কিনতে ভিড় জমায়। এতে সুপারমার্কেট ও অন্যান্য দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা ফুড ডেলিভারি ও ই-কমার্স থেকে শুরু করে আউটসোর্সিং খাত ক্ষতির মুখে পড়ে। কারণ ইন্টারনেটের অভাবে তারা ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় দেশের তৈরি পোশাক খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অথচ দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ এই খাত থেকে আসে।

এ সহিংসতায় অর্থনৈতিক ক্ষতির আরও তথ্য এখনো সামনে আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি আদেশ কমে যেতে পারে, কারণ বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি হবে। পাশাপাশি প্রবাসী আয় আসার পরিমাণও কমতে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া বিষয়ক প্রোগ্রাম ডিরেক্টর পিয়েরে প্রকাশ ২৫ জুলাই এক প্রতিবেদনে বলেন, 'সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, দেশের এই অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে অন্যদেশে ঝুঁকতে পারে। আর এই আন্দোলনের প্রভাব আগে থেকেই অসুস্থ অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।'

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, সাত দিনের অর্থনৈতিক ব্যয় ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

সবমিলিয়ে দেশের মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বোঝা ভারী হয়ে উঠছে। কিন্তু, প্রশ্ন হলো- এই ক্ষতির দায় নেবে কে?

কারণ যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের ভরণপোষণ তাদেরই করতে হবে। আর যারা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা পঙ্গু হয়েছে- তাদের বাকিটা জীবন এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ঠিক করতে সরকার করদাতাদের অর্থ ব্যবহার করবে। আর এমন সময়ে এই ব্যয় বাড়বে যখন বাংলাদেশ এমনিতেই অর্থ সংকটে রয়েছে, এবং অর্থনীতিবিদরা অর্থের অপচয় এড়াতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

ফলে অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত সরকারকে উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ রাখতে হবে, যা ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

রাজধানীতে একটি ছাপাখানার মালিক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় আমাকে প্রায় ছয় দিনের জন্য কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। কিন্তু লোকসান হলেও শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে।'

কোটা সংস্কার আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করায় নিম্ন-আয়ের মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে। এমনিতেই গত দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তার মধ্যে এই সংকট তাদের জন্য নতুন আরেকটি ধাক্কা হিসেবে এসেছে।

অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, মানবসৃষ্ট এই সংকটের সব ব্যয় সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ।

তিনি বলেন, 'অতীত দেখেছি, যেকোনো সংকটে এই গোষ্ঠীগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ তাদের সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা কম।'

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, 'সুতরাং এবারও সংকটের বোঝা তাদের ওপরেই আঘাত হানবে।'

অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেননি প্রবাসীরা। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ইন্টারনেট চালু হওয়ায় ধীরে ধীরে আইটি খাত স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু ইন্টারনেটের গতি এখনো বেশ কম।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক বিপু চৌধুরী বলেন, বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর রেস্তোরাঁ মালিকরা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'ওই অগ্নিকাণ্ডের পর এই পাঁচ মাসে সেই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারলেও এ মাসের শেষ দুই সপ্তাহে রেস্তোরাঁর বিক্রি দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে গেছে।'

এই সংকট পোশাক শিল্পকেও বিপর্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, 'শিপমেন্টে দেরি হলে এ খাতের ক্ষতি হবে।'

তিনি জানান, কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন ইউনিট খোলা রাখলেও ইন্টারনেটের অভাবে ব্যবসা কার্যত থেমে ছিল। এছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শিপমেন্ট জমে গেছে, কারণ সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।

এতে কিছু কোম্পানি অর্ডার বাতিল হয়েছে। তাই কিছু কোম্পানি আকাশপথে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হয়েছে।

'যদিও এখন সংকট নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে মনে হচ্ছে, তারপরও রপ্তানিকারকদের ওপর এক মাসের বেশি সময় এর প্রভাব থাকবে। কারণ সময়মতো সরবরাহ করতে না পারা অর্ডার জমে আছে।'

(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)

Comments

The Daily Star  | English

Child rape cases rise nearly 75% in 7 months

Child rape cases in Bangladesh have surged by nearly 75 percent in the first seven months of 2025 compared to the same period last year, according to data from Ain o Salish Kendra (ASK).

5h ago