ইন্টারনেট বন্ধ রাখায় কী বার্তা পেলেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা?

এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের মাঝে দেশের ভাবমূর্তিতে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে।
কোটা সংস্কার, মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ, ফেসবুক, ফ্রিল্যান্সার, পোশাক খাত,
দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ফ্রিল্যান্সারদের কাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। স্টার ফাইল ফটো

সম্প্রতি দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রায় এক সপ্তাহের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের মাঝে দেশের ভাবমূর্তিতে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে।

এরপর গত ৩১ জুলাই ফেসবুক, টিকটক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুনরায় চালু করা হয়। এর ঠিক দুদিন পর কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোন অপারেটরদের ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে আবারও বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে বলে। ফলে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সামাজিক মাধ্যমে ঢুকতে আবারও সমস্যায় পড়েন।

যদিও মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা প্রায় ছয় ঘণ্টা পর ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে প্রবেশ করতে পেরেছিল, তবে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত দেশের জন্য নেতিবাচক সংকেত দেয়।

ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো বিনিয়োগকারী এমন কোনো দেশে অর্থ বিনিয়োগ করতে চান না, যেখানে তারা অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।

গার্মেন্টস পণ্যের ক্রেতারাও একই চিন্তা করেন। কারণ কোনো দেশের পণ্য সরবরাহ যদি সপ্তাহের পর সপ্তাহ বন্ধ থাকে ও ক্রেতারা সংশ্লিষ্ট দেশের কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে, তাহলে ওই দেশ থেকে সময়মতো পণ্য পেতে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়।

অন্যদিকে যারা ফ্রিল্যান্সারদের দিয়ে কাজ করান তারাও এভাবেই ভাবেন। কারণ দিনশেষে তারা সময়মতো কাজ পেতে চান।

সুতরাং অন্য দেশে বিনিয়োগের বা পণ্য কেনার পর্যাপ্ত বিকল্প থাকলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে কোনো বিনিয়োগকারী ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় নেওয়া হলে এটাই স্বাভাবিক।

বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করা হলে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা স্পষ্ট আত্মঘাতী একটি সিদ্ধান্ত ছিল। এর মাধ্যমে সরকার মানুষকে অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করেছিল, যেন দেশে কী ঘটছে তা তারা জানতে না পারেন।

যদিও এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত উল্টো ফল ডেকে আনে ও মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে।

এর আগে, দেশে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে শেয়ারবাজারে সূচকের পতন ঠেকাতে কয়েক বছর ফ্লোর প্রাইস চালু রাখা হয়েছিল। তখন শেয়ারবাজার নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মাঝে এ ধরনের প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলেও সূচকের পতন ঠেকানো যায়নি।

একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার, সরকার যদি বাস্তবতা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বা আড়াল করার চেষ্টা করে, তাহলে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর বাস্তব দৃশ্যটি আরও বড় আকারে মানুষের সামনে আসে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তাই সরকারের উচিত বাস্তবতা আড়াল না করে দেশে শান্তি ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করা।

অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক অভিজ্ঞ ব্যাংকার মামুন রশিদ বলেন, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) খুবই প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বাজারটি ভালোভাবে ধরতে পেরেছে।

তিনি বলেন, 'সরকার সহযোগিতা করায় আউটসোর্সিং খাত ভালো করেছে। কিন্তু সম্প্রতি ইন্টারনেট বন্ধ রাখায় এই খাতে বাজে প্রভাব পড়েছে।'

'এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়, তাই ইন্টারনেটে কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটলে তা সংশ্লিষ্টদের ওপর প্রভাব ফেলে,' যোগ করেন তিনি।

তার ভাষ্য, 'ক্রেতারা যেনে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার বিষয়টি বুঝতে না পারে সেজন্য অনেকে তাদের কাজ অব্যাহত রাখতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবেশী দেশে চলে যান। কারণ ক্রেতারা যদি বুঝতে পারেন, ইন্টারনেট ঘন ঘন বিঘ্ন ঘটছে- তাহলে তারা কার্যাদেশ অন্য দেশে সরিয়ে নিতে পারে।'

একজন রপ্তানিকারক জানান, তার ক্রেতা ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ কাজের আদেশ কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে সরিয়ে নিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবা যদি আরও ব্যাহত হয়, তাহলে অন্যান্য ক্রেতারাও মুখ ফিরিয়ে নেবে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শীর্ষস্থানীয় এলইইডি সনদপ্রাপ্ত পোশাক কারখানার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রম করে তিনি সময়মতো পণ্য সরবরাহ করে সুনাম অর্জন করেন।

তিনি জানান, কিন্তু সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতা তার শিপিংয়ে প্রভাব ফেলেছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি কারফিউ চলাকালে তাকে কারখানা বেশ কয়েকদিন বন্ধ রাখতে হয়েছে। যদিও এই সময়ে আকাশপথে পণ্য পাঠাতে হয়েছে, যা ছিল বেশ ব্যয়বহুল।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অন্যদিকে দেশের পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে, এতে তাদের কার্যক্রমে আরও প্রভাব পড়বে। এভাবে চলতে থাকলে ক্রেতারা বিকল্প পথে বেছে নিবেন।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, তাদের সামনে অন্যান্য বিকল্প থাকতে তারা কেন আমাদের এখানে কাজের আদেশ দেবে?

তার ভাষ্য, শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ থাকায় গার্মেন্টস ক্রেতারা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হননি, কারণ এতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত তাদের কাছে ইতিবাচক কোনো বার্তা পাঠায় না।

'তাই সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কাজ করা। অন্যথায় পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা ইতোমধ্যে চাপে মধ্যে থাকা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Yunus speech on martyrs dreams

US plans talks on economy with Yunus, FT says

The United States is set to launch economic talks this week with Bangladesh's interim government, including its leader, Muhammad Yunus, the Financial Times reported on Tuesday

1h ago