রোজিনার নায়কেরা

এক সময়ের সাড়া জাগানো নায়িকা রওশন আরা রোজিনা তিন শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সামাজিক, পোশাকি, রোমান্টিক, অ্যাকশন—সব ধরনের সিনেমায় সরব ছিলেন অনেক বছর। নায়ক রাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, ওয়াসিম, জাফর ইকবাল, বুলবুল আহমেদ, জসীমসহ অনেকের বিপরীতে নায়িকা হয়েছেন রূপালি পর্দায়। শুধুমাত্র নায়ক ওয়াসিমের বিপরীতেই শতাধিক সিনেমায় জুটি বেঁধেছেন তিনি।
জাতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত এই নায়িকা দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন তার নায়কদের নিয়ে।

রাজ্জাক
যাদের সিনেমা দেখে অভিনয়ে এসেছি, তাদের বিপরীতে একসময় নায়িকা হয়েছি। এটাই সত্যি, বাস্তবতা। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন নায়ক রাজ্জাক। তিনি নায়করাজ। তাকে নিয়ে কিছু বলা কঠিন। কেননা, তিনি অনেক বড় মাপের অভিনেতা, বড় মাপের নায়ক। আমারও নায়ক। অনেক সিনিয়র ছিলেন তিনি। রাজ্জাক ভাই শুধু আমার নায়ক ছিলেন না, তাকে একজন শিক্ষক ও অভিভাবক ভাবতাম। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে তার শেষ জীবন পর্যন্ত তাই ভেবেছি।
তার বিপরীতে প্রথম অভিনয় করি 'আয়না' সিনেমায়। শুটিংয়ের দিন বেশ নার্ভাস ছিলাম। সংলাপ ভুল হচ্ছিল। তারপর রাজ্জাক ভাই বুঝতে পেরে শুটিং বন্ধ করে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমাকে সহজ করে দেন। তখন আমি নতুন নায়িকা। ওই ঘটনা সারাজীবন মনে রেখেছি। নায়ক হিসেবে পর্দায় তাকে যেমন পেয়েছি, বড় ভাই হিসেবেও কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে নায়ক হিসেবে তার কাছ থেকে যে সাহস ও উৎসাহ পেয়েছিলাম, তা ভুলব না কখনোই।
আলমগীর
আলমগীর ভাইও আমার অনেক সিনিয়র ছিলেন। তার বিপরীতেও নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছি। সত্যি কথা বলতে তিনি একজন ভালো অভিনেতা। ভালো মানুষ। আমি তার মধ্যে কোনো অহংকার দেখিনি। সবসময় দেখেছি তিনি খুব মিশুক। সহশিল্পীকে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারার যোগ্যতা তার ছিল। কখনো পর্দায় তার প্রেমিক হয়েছি। নায়ক হিসেবে শতভাগ সহযোগিতা করেছেন। তার কাছ থেকে সবসময় সহযোগিতা পেয়েছি। কত শত স্মৃতি রয়েছে আমাদের। কেবলমাত্র এফডিসিকে কেন্দ্র করেই অসংখ্য স্মৃতি। আলমগীর ভাই নায়ক এবং গায়কও। বেশ ভালো গান গাইতে পারেন। তার গাড়িতে বসে কোথাও যাওয়ার সময় গান শুনেছি। আনন্দ করতে ভালোবাসেন। নায়ক হিসেবে তিনি অসাধারণ।
ওয়াসিম
সবচেয়ে বেশি সিনেমা করেছি নায়ক ওয়াসিমের বিপরীতে। এত এত সিনেমা করেছি যে রেকর্ড হয়ে আছে আমার নায়িকার ক্যারিয়ারে। শতাধিক সিনেমা করেছি। আমাদের জুটিকে দর্শকরা ভীষণভাবে গ্রহণ করেছিলেন। ওয়াসিম-রোজিনা নামটি একসময় সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। সেসব কথা ভাবলেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। পেছনে চলে যাই। এখনো নতুন প্রজন্মের দর্শকরা আমাদের সাদাকালো যুগের সিনেমাগুলো দেখেন। সেসব সিনেমার গান এখনো শোনা যায় অনেকের মুখে। ওয়াসিম ভাই হাসি-খুশি মানুষ ছিলেন। শুটিং করার সময় সেট মাতিয়ে রাখতেন। পর্দায় আমাদের দুজনের বন্ডিংটা ভালো ছিল। ফোক, সামাজিক, রোমান্টিক সব ধরনের সিনেমা করেছি তার বিপরীতে। সব ঘরানার সিনেমা ব্যবসাসফল হয়েছে। 'বিনি সুতার মালা' সুপার-ডুপার হিট হয়েছিল। 'রসের বাইদানী' খুব সাড়া ফেলেছিল। মিস ললিতা, মানসী, রাজিয়া সুলতানা, তুফান মেইল... কত সিনেমার নাম বলব? তিনি অমায়িক মানুষ ছিলেন।
ফারুক
তাকে তো শুধু নায়ক না, মিয়াভাই হিসেবেই জানতাম। দুনিয়ায় না থেকেও এখনো তিনি মিয়াভাই হয়ে আছেন। অনেক সিনেমা করেছি দুজনে। নারায়ণ ঘোষ মিতার পরিচালনায় প্রচুর সিনেমায় আমি ও ফারুক ভাই অভিনয় করেছি। সেসব কথা মনে হলে কষ্ট হয়। সেসব দিন আর ফিরে পাব না। খুব ভালো মানুষ ছিলেন ফারুক ভাই। তাকে দেখলেই মনে হতো, জন্মই যেন হয়েছে সিনেমার জন্য। সকাল-বিকাল শুটিং করেছি। দুই শিফট ভাগ করে শুটিং করেছি। রাত দিন কাজ করেছি। তাকে মনে হতো পরিবারেরই একজন। আমার নায়ক ফারুক ভাই যেখানে আছেন, ভালো থাকুন।
জাফর ইকবাল
নায়ক জাফর ইকবাল ছিলেন ফ্যাশন সচেতন একজন নায়ক। সেই সময়ে তার মতো ফ্যাশন সচেতন নায়ক কমই দেখেছি। অসম্ভব স্মার্ট একজন নায়ক ছিলেন। কালারফুল ছিলেন খুব। জাফর ইকবালও আমার নায়ক ছিলেন। একসঙ্গে শুটিং করতে গিয়ে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নায়ক হিসেবে সফল ছিলেন এবং গায়ক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন। ভালো গান করতে পারতেন। তার গান শুনেছিও। খুব সুদর্শন ছিলেন দেখতে। ১৯৯১ সালে জাফর ইকবাল হঠাৎ করে মারা গেলেন। ওই বছরই জানুয়ারিতে আমরা দুজন কক্সবাজারে শুটিং করে আসি। ওটাই শেষ দেখা। তাকে খুব মনে পড়ে। আমার পছন্দের নায়ক তিনি। মানুষ হিসেবেও ভালো ছিলেন।
সোহেল রানা
অনেক সিনেমা করেছি তার সঙ্গে। তিনিও আমার নায়ক। তিনি সেটে আসতেন, কাজ করতেন, তারপর চলে যেতেন। খুব ব্যক্তিত্ববান মনে হতো। চুপচাপ স্বভাবের মানুষ মনে হতো তাকে। আবার ভালো অভিনেতা তো অবশ্যই। তাকে দেখে মনে হতো এত বড় নায়ক! পরে বন্ধুর মতো হয়ে যান কাজ করতে করতে। কখনো বন্ধু, কখনো বড় ভাই ভাবতাম তাকে। সোহেল রানা ভাইকে সবাই ডাকতেন পারভেজ ভাই। আমিও তাই ডাকতাম। ভীষণ সিরিয়াস অভিনেতা ছিলেন। যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেন অন্য মানুষ হয়ে যেতেন।একসঙ্গে কাজ করার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে।
বুলবুল আহমেদ
নায়ক বুলবুল আহমেদ খুব ভালো মানুষ ছিলেন। সরল-সহজ মানুষ ছিলেন। তার ভেতরে কোনো ঝুট-ঝামেলা দেখেনি। মজার বিষয় হচ্ছে, জোকস পছন্দ করতেন তিনি। হাসি-খুশি থাকতেন। অনেক ভালো অভিনেতা তিনি। যখন যে চরিত্র করতেন, সেটা নিয়েই থাকতেন। দেখে মনে হতো না এসব চরিত্র তিনি পারবেন। অথচ কী সাবলীলভাবেই অভিনয় করতেন! পর্দায় যখন দেখতাম মুগ্ধ হয়ে যেতাম।
জসীম
'রাজমহল' সিনেমায় প্রথম একক নায়িকা হিসেবে অভিনয় করি। সেই সময় জসীম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তখনো তিনি নায়ক হননি। ফাইট ডিরেকশন দিতেন। এফডিসিতে তাকে প্রথম দেখি। সেই স্মৃতি আজও মনে পড়ে। পরিচয়ের পর ফাইটের শুটিং করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। জসীম ভাই বেশ সহযোগিতা করেছেন। তারপর তো নায়ক হন তিনি। আমারও নায়ক হন। মজার মানুষ ছিলেন জসীম ভাই। হাস্যরস পছন্দ করতেন। মনেই হতো না এত মজা করতে পারেন। দুজনে অনেক কাজ করেছি। বড় মনের মানুষ ছিলেন। বড় মনের শিল্পী ছিলেন। দর্শকরা তাকে খুব পছন্দ করতেন। আমিও পছন্দ করতাম, সম্মান করতাম।
Comments