বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে অধ্যাপক এম শামসুল আলমের পর্যবেক্ষণ

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে সারাদেশ বিদ্যুৎহীন থাকলেও কেন বিপর্যয় ঘটল, এখন পর্যন্ত তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং কমবে এবং অক্টোবর থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু, অক্টোবরে এসে লোডশেডিং আরও ‘ভয়াবহ’ আকার ধারণ করেছে।

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে সারাদেশ বিদ্যুৎহীন থাকলেও কেন বিপর্যয় ঘটল, এখন পর্যন্ত তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং কমবে এবং অক্টোবর থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু, অক্টোবরে এসে লোডশেডিং আরও 'ভয়াবহ' আকার ধারণ করেছে।

জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ কী? সর্বশেষ বিদ্যুৎ বিভাগ জানাল নভেম্বর থেকে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আসলেই কি তা হবে? বর্তমানে দেশের বিদ্যুতের প্রকৃত অবস্থা কী? চলমান সংকট নিরসনে করণীয় কী হতে পারে?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলমের সঙ্গে। তার ভাষ্য, বিদ্যুৎ সংকট সারাদেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। কিন্তু, আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি না।

জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'যেকোনো কিছুই ব্যবহার করতে হলে তা ব্যবহারের কিছু শর্ত থাকে। সেগুলো মেনে তার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রিডে দেওয়া হবে। গ্রিড সেই বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ ভোক্তাদের জন্য বিতরণ প্রতিষ্ঠানকে সেটা দেবে গ্রিড। বিদ্যুৎ নেওয়ার জন্য বিতরণ প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মানতে হবে। সেই শর্তগুলো গ্রিড কোডে স্পষ্ট করে বলা আছে। এখন সেই গ্রিড কোড মানার বিষয়টি উৎপাদনকারীরাও নিশ্চিত করে না, বিতরণ প্রতিষ্ঠানও করে না।'

'গ্রিডে যে বিপর্যয় ঘটেছে বলা হলো, প্রকৃতপক্ষে সবসময় গ্রিড এমন বিপর্যয়ের মধ্যেই থাকে। এর মধ্যে থেকেই সাসটেইন করে। আবার যখন বেশি অসহনীয় হয়ে যায়, তখন ফেইল করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটাই হয়েছে। যেটা শোনা যাচ্ছে যে, কোনো লাইনে বিদ্যুৎ ওভারলোডেড হয়ে গেছে। সেই ওভারলোডের মাত্রা এত বেশি হয়েছে যে, সেটা আর সইতে পারেনি বলেই এ বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু, এটা তো গ্রিডের দোষ না। যদি আসলেই গ্রিডের দোষ হতো, তাহলে উৎপাদন ও বিতরণ উভয় দিকই ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কিন্তু, তা হয়নি। যা হয়েছে তা হলো গ্রিড সবকিছু অফ করে দিয়েছে, যেমন বাড়িতে সার্কিট ব্রেকার পড়ে যায়। কারো বাড়িতে যদি লোড বেড়ে যায়, তাহলে সার্কিট ব্রেকার পড়ে যায় বা ফিউজ কেটে যায়। এর অর্থ সেই বাড়ির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার কোনো জায়গায় ত্রুটি হয়েছে। এক্ষেত্রেও তাই। আমাদের সঞ্চালন লাইন সবসময়ই এরকম ঝুঁকির মধ্যে থাকে', বলেন তিনি।

গ্রিড কোড যাতে যথাযথভাবে মানা হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের উল্লেখ করে এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের অদক্ষতা ও অনুপযুক্ততার কারণেই আজকের এ বিপর্যয় ঠেকানো যাচ্ছে না এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এরকম বিপর্যয়ের সমাধান হিসেবে তারা বলবে, গ্রিড ভেঙে আরও টুকরো টুকরো করতে, গ্রিডে আরও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বাড়াতে, বর্তমান গ্রিডকে স্মার্ট গ্রিড করতে। এসবের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ব্যবসা, কেনা-বেচা হবে এবং এর মাধ্যমে অর্থ তছরুপ হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।'

লোডশেডিং বিষয়ে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'চলমান পরিস্থিতির উন্নয়নে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর জন্য জ্বালানি প্রয়োজন। ফলে জ্বালানি সরবরাহ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে জ্বালানি আমদানি করতে হবে। সেই আমদানির সক্ষমতা আমরা ডিসেম্বরে অর্জন করব, এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। আরেকটা কথা যেটা তারা বলেছে যে, রামপালে বিদ্যুৎ আসবে। কিন্তু, সেটার জন্যও তো কয়লা ডলার দিয়ে কিনে আমদানি করতে হবে।'

'কয়লা, তেল বা গ্যাস ক্ষেত্রে এখন আমরা আমদানি-নির্ভর। দেশীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জ্বালানির যোগান দিতে গেলে অর্থ লাগবে। আমরা সেই অর্থ সংকটে আছি। সেই সংকটটা নভেম্বরে কেটে যাবে, আর বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, তা আমি যৌক্তিক মনে করি না। লোডশেডিং কমাতে পারলেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে গেল, সেটা মানতেও আমি রাজি নই। আরেকটা বিষয় হলো যদি লোড কমে যায়, তাহলে তো বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আগের চেয়ে স্বাভাবিক হবে। অক্টোবর-নভেম্বরে তো এমনিতেই লোড কমে যাবে। সুতরাং তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন এমনিতেই কম করতে হবে। কিন্তু, এতে তো সমস্যার সমাধান হলো না', বলেন তিনি।

দেশের বিদ্যুৎ খাতের প্রকৃত অবস্থা এবং চলমান সংকট নিরসনে করণীয় বিষয়ে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'আমাদের যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার, তা উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি দরকার, সেটার ব্যবস্থা আমরা করতে পারছি না অর্থের অভাবে। অর্থের অভাবের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ব্যয় হবে, তার জন্য মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে বা ভর্তুকি দিতে হবে। এখন সরকার আর ভর্তুকি দিতে পারছে না। আর মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তা সইতে পারবে না। এ সমস্যায় থেকে উত্তরণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে। সেই ব্যয় কমাতে না পারলে সমস্যার সমাধান হবে না। ব্যয় কমাতে হলে এ খাতের যত রকমের দুর্নীতি আছে, তা বন্ধ করতে হবে। যেসব জায়গা লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়ে, লুণ্ঠনমূলক মুনাফা আছে, সেসব জায়গায় ব্যয় ও মুনাফা বিইআরসির মান অনুযায়ী যৌক্তিক করতে হবে। মোদ্দা কথা, বিদ্যুৎ সঞ্চালন, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে অযৌক্তিক ব্যয় থেকে মুক্ত করতে হবে।'

একইসঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে দেশীয় সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, 'এক্ষেত্রে বিদেশি নয়, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা করতে হবে। আমদানির পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দর বাড়লেও আমরা তা মোকাবিলা করতে পারব। এ কাজগুলো করতে পারলে গণবান্ধবসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ খাত তৈরি করা সম্ভব হবে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে জনগণের কাছে প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।'

চলমান বিদ্যুৎ সংকট দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে পঙ্গু করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করে এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'খাদ্য সংকট হলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে আমরা নানাবিধ দুর্ভিক্ষের মধ্যে আছি। এটাই সত্য। সমাজের সুবিধাবাদীদের যেমন দুর্ভিক্ষ স্পর্শ করে না, তেমনি চলমান সংকটের তীব্রতা বিত্তবানদের স্পর্শ করছে না। সে কারণেই জাতীয়ভাবে বা সরকারের মধ্যে এটাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। খাদ্যের অভাবে যেমনি প্রান্তিক মানুষ কষ্ট পায়, তেমনি বিদ্যুৎ সংকটের কারণেও তারাই নানামুখী কষ্ট পাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ হলে যেমন গুরুত্ব দিতে হয়, এ পরিস্থিতিকে আরও অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ বিদ্যুৎ সংকট সারাদেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। কিন্তু, আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি না।'

Comments