রেকর্ড উৎপাদনেও লোডশেডিংয়ে নাকাল গ্রামাঞ্চলের মানুষ

‘দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হলে আগুনে পুড়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। আর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে রাতে বাড়িতে থাকাও সমান কষ্টকর। মনে হয় সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।’

সপ্তাহ ধরে বয়ে চলা তাপপ্রবাহের মধ্যে শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং অতিষ্ঠ করে তুলেছে জনজীবন।

গ্রীষ্মের উষ্ণতম দিনগুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রতিদিন পিক আওয়ারে (দিনের যে সময় সর্বোচ্চ চাহিদা হয়) গড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছিল সরকার।

গত সোমবার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদনের রেকর্ড করে। কিন্তু ওই রেকর্ডের দিনেও সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ২২১ মেগাওয়াট, যা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

পিডিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত সপ্তাহে পিক আওয়ারে দেশে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল।

বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর মতে, বিদ্যুৎ থাকছে না—এই পরিস্থিতি বেশির ভাগই গ্রামীণ এলাকায় দেখা যাচ্ছে।

অর্থাৎ, মানুষ শুধু প্রচণ্ড গরমে ভুগছে না-তারা বোরো ধানের খেতে সেচ দেওয়ার জন্য পানির পাম্পও চালাতে পারছে না।

গত কয়েকদিনে ফেনী ও ময়মনসিংহের একাধিক স্থানে শতাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।

জনগণের 'অসন্তোষ ও ক্ষোভ' দেখে শঙ্কিত হয়ে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ গতকাল জেলা পুলিশ সুপারের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র বা স্থাপনাসমূহ ও তার সহকর্মীদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

'তীব্র গরমের সময় অসহনীয় লোডশেডিংয়ের কারণে সম্মানিত গ্রাহকগণ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এবং সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে,' চিঠিতে লেখেন তিনি।

দেশের ২৩টি জেলার অর্ধশতাধিক মানুষ দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন যে, দিনে ১০ থেকে ১৯ বার পর্যন্ত বিদ্যুৎ চলে যায়। দিনে মোট ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না তারা।

অপ্রত্যাশিত বিদ্যুৎ সংকটে তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। গত বছর বিতরণ কোম্পানিগুলো আগে থেকেই লোডশেডিংয়ের সময় সূচি প্রকাশ করেছিল, যেটা কিছু ক্ষেত্রে কাজে এসেছিল কিন্তু এবার কখন কোথায় বিদ্যুৎ যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না।

গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। পিবিএস কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রাহকদের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কম।

রমজানের প্রথম ৩ সপ্তাহ ঢাকা মহানগরীসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছে সরকার। রাজধানীবাসীকে এখনো চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। কিন্তু দিনে দিনে গরমের তীব্রতা যতই বাড়ছে, অন্য শহরগুলোতে ভোগান্তি বাড়ছে।

গতকাল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দুঃখ প্রকাশ করেন।

তিনি লিখেছেন, 'এ বছর গ্রীষ্ম, সেচ মৌসুম এবং রোজা একসাথে হওয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছবে সেটা আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্ব প্রস্তুতির স্বাক্ষরও রেখেছি। কিন্তু গত ৫০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙ্গে বর্তমানে যে নজিরবিহীন দাবদাহ চলছে তাতে ধারণার চেয়েও বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে।'

সাধারণ মানুষ, বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের প্রতি তিনি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বলেন, 'পরিস্থিতি উত্তরণে বিদ্যুৎ বিভাগ সর্বাত্মক কাজ করছে।'

পিডিবি গতকাল ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নতুন রেকর্ড গড়েছে।

দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। কিন্তু কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ বা জ্বালানি সংকটের কারণে বন্ধ রাখতে হয় বলে জানান পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান।

তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতোই বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। প্রতিনিয়ত রেকর্ড উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এখন মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিরিক্ত গরম। এই সময় এত গরম পড়বে, সেটা ধারণারও বাইরে ছিল।'

'যদি আধা ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টি হয় তাহলে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কমে যাবে,' তিনি যোগ করেন।

বন্দর নগরী চট্টগ্রামে দিনে ৮ থেকে ১০ বার করে বিদ্যুৎ যাচ্ছে।

ভোগান্তি বেশি ময়মনসিংহে

গত ৫ এপ্রিল থেকে ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলায় এমন কোনো দিন নেই, যেদিন লোডশেডিং করতে হয়নি।

গত সোমবার পল্লী বিদ্যুতের চাহিদার ঘাটতির সবচেয়ে বেশি ছিল ময়মনসিংহ জোনে; ৪৪২ মেগাওয়াট।

টাঙ্গাইলের কৃষকরা জানিয়েছেন, সেচের অভাবে বোরো ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।

সখীপুর উপজেলার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তীব্র গরমে ধানের ব্লাস্ট রোগ (ছত্রাক থেকে হওয়া) রোধে প্রচুর সেচ দিতে হয়। কিন্তু ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং কম ভোল্টেজের কারণে আমরা প্রয়োজনীয় পানি সেচ দিতে পারছি না।'

টাঙ্গাইল শহরের দিঘুলিয়া এলাকার বাসিন্দা মিলকান খান ডেইলি স্টারকে বলেন, সোমবার ভোররাত ১২টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিনি ১৯ বার বিদ্যুৎ গেছে।

পিডিবি ও পিবিএস কর্মকর্তাদের মতে, জেলায় দৈনিক ২৮০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১৪০-১৮০ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে।

রামপাল উৎপাদনে যেতে আরও অপেক্ষা

গত ১৫ এপ্রিল উৎপাদন বন্ধ করার আগে বাগেরহাটের রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল।

বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহ জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে এবং ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় লোডশেডিংয়ের কারণে ধান খেতে সেচ ব্যাহত হচ্ছে, জানিয়েছেন স্থানীয়রা বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা বাসিন্দারা আরও জানান, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে উষ্ণ জেলা চুয়াডাঙ্গায় দিনে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এই জেলায় ৭৫ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে ৫২ থেকে ৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছে পল্লী বিদ্যুতের অফিসগুলো।

সাতক্ষীরায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

'বিদ্যুৎ যায় না, মাঝে মাঝে আসে'—বিদ্যুতের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এমন মন্তব্য করেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান।

দিনে ৮ থেকে ১০ বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় গত ৪ দিন ধরে পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার বর্ষা গ্রামের বাসিন্দা লিয়াকত আলী জানান, এই প্রচণ্ড গরমে তার ২ সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা মো. আইয়ুব বলেন, 'দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হলে আগুনে পুড়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। আর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে রাতে বাড়িতে থাকাও সমান কষ্টকর। মনে হয় সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।'

সেচ সমস্যায় উত্তরাঞ্চল

ময়মনসিংহের পরে ভোগান্তিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রংপুর বিভাগ। এই বিভাগে রয়েছে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রাম জেলা।

১৭ এপ্রিল এই বিভাগে ১৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এই অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদার অনেকটা পূরণ করে। কিন্তু সেটিও পুরো দমে চলছে না।

লোডশেডিংয়ের কারণে এই অঞ্চলেও সেচ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজোশ গ্রামের একটি সেচ পাম্পের মালিক আব্দুর রউফ জানান, সোমবার রাতে ৩ বার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল।

'এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা সঠিক সময়ে আমাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে পারব না,' বলেন আল মদিনা মেটাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী আবদুল মালেক।

'দিনে ৫ থেকে ৬ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। নির্ধারিত কোনো সময় সূচি নেই। রাতে বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আমরা ঘুমাতে পারি না,' বলেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন পাবনা সদর উপজেলার গাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুল লতিফ।

রংপুর জোন-৩ এর নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুবুল হক বলেন, 'জোনের অধীনে দৈনিক চাহিদা প্রায় ১৪ মেগাওয়াট কিন্তু গত ৩ দিন ধরে দৈনিক মাত্র ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।'

উল্লেখিত জেলার সংবাদদাতা প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English
IMF calls for smaller budget

IMF suggests raising power, gas and fertiliser prices

The International Monetary Fund yesterday recommended reducing government subsidies by hiking prices of power, gas and fertiliser, and spending the saved money on society safety net programmes.

16h ago