সক্ষমতা আছে, বিদ্যুৎ নেই: গরমে হাঁসফাঁস জীবন

সক্ষমতা আছে, বিদ্যুৎ নেই: গরমে হাঁসফাঁস জীবন
স্টার ফাইল ফটো

দেশের ৪ জেলায় তীব্র এবং অন্যান্য জেলাগুলোতে বইছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। এর পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি মানুষের বাড়তি যন্ত্রণার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না, কোথাও কোথাও ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রামাঞ্চলের কিছু এলাকায় ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্যমতে, ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে গতকাল সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৬৩৫ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৭৮১ মেগাওয়াট।

গতকাল দিনের বেলা পিক আওয়ারে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২৪৭ মেগাওয়াট।

দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ আছে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট। আরও সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জ্বালানির সংকটে উৎপাদন করা যায় না।

কয়লা ও ফার্নেস তেল সংকটে বাকি ১৬ হাজার মেগাওয়াট থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে গড়ে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট থেকে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট।

এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট থেকে ১ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে।

দেশে এখন গ্যাসের সরবরাহ আগের চেয়ে বেশি, তবে সেটাও অপ্রতুল। কেননা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট, এখন উৎপাদন হচ্ছে ৬ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট।

এদিকে তীব্র গরমে বারবার লোডশেডিংয়ের কারণে হাঁসফাঁস করছে দেশের মানুষ। বিশেষ করে শিশু ও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভোগা মানুষেরা বেশি কষ্টে আছেন।

রাজধানী খিলগাঁও এলাকার রুবেল মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অতিরিক্ত গরম, তার ওপর আবার বিদ্যুৎ থাকে না। আমাদের এখানে প্রায় প্রতি দিন রাত ১২টায় ১ বার যায় আবার ভোর ৫টার দিকে ১ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। গেলে ১ ঘণ্টা পর আসে। গরমের কারণে আমার বাচ্চাটার ঘামাচি বের হওয়া শুরু হয়েছে।

'লোডশেডিংয়ের কারণে সারারাত ঘুমের সমস্যা হওয়ায় প্রভাব পড়ে দিনের বেলা কাজের ওপর। ঠিক মতো কাজ করতে পারি না।'

রাজধানীর বসিলার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী বাচ্চু শেখ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গড়ে হিসাব করলে আমাদের এখানে ৪ ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ থাকে না। সবচেয়ে কষ্ট হয় রাতে। আমার ৩ বছরের বাচ্চাটা খুব কান্নাকাটি করে। কেউ ঘুমাতে পারি না।'

শনিরআখড়া থেকে তাফান্নুম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ছোটো ভাইয়ের পরীক্ষা চলছে। বিদ্যুৎ না থাকায় পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে তার। তাছাড়া আমার এলাকায় মশা অনেক বেশি। ফ্যান ঘুরলে মশা একটু কম লাগে। জুনের ১ তারিখে ৬ থেকে ৭ বার বিদ্যুৎ গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ থেকে চারবার গেছে। বিদ্যুৎ গেলে ১ ঘণ্টার মতো থাকে না। গরম, মশা সবমিলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।'

'আমার বাবা স্ট্রোকের রোগী। বিদ্যুৎ চলে গেলে খুব অস্থির হয়ে যান। মা ঘরের কোনো কাজ করতে পারেন না,' বলছিলেন আদাবরের বাসিন্দা মো. শরিফুল্লাহ।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার এখানে রাত ২টার দিকে ১ বার এবং ভোর ৫টার দিকে আরেকবার বিদ্যুৎ চলে যায়। গতকাল সারাদিনে দিনে ৩ বার বিদ্যুৎ গেছে। গেলে ১ ঘণ্টা পর আসে।'

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার কালিয়াগঞ্জ এলাকার মো. তৈমুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এখানে প্রতি দেড় থেকে ২ ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ চলে যায়। আর গেলে ২ ঘণ্টা পর আসে। এভাবেই সারাদিন চলে। রাতে অনেক কষ্ট হয়। এমনিতেই আমাদের এখানে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে তার ওপর আবার বিদ্যুৎ থাকে না। খুব কষ্ট আছি।'

সাভারের ফুলবাড়িয়ার গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনকারী ফাহিম ওয়্যার হাউজ বিডির স্বত্বাধিকারী ফাহিম সাজ্জাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ফ্যাক্টরিতে ২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরবর্তী ২ ঘণ্টা থাকে না। আমার আজকে ২ হাজার জার্সি ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে ফ্যাক্টরিতে ১ হাজার উৎপাদন হয়েছে। বাকি ১ হাজার ডেলিভারি দিতে পারব না। এভাবে চলতে থাকলে দেশের বাইরের অর্ডার নিয়ে বড় ধরনের বিপদে পড়ব।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রংপুরের এক ক্লিনিকের মালিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রংপুর মেডিকেল মোড় এলাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল। তবে গ্রামাঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় বিদ্যুৎ ছিল ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। বিদ্যুৎ দীর্ঘসময় না থাকার কারণে ফ্রিজে থাকা খাবার নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে মানুষ অনেক কষ্টে আছেন।'

তিনি বলেন, 'সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে রাতে। কেউ ঘুমাতে পারছেন না। শিশুরা গরমে কান্না করছে। যাদের শ্বাসকষ্ট আছে তারা অনেক ভোগান্তিতে পড়েছে।'

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আজ রোববার জানিয়েছে, রাজশাহী, নওগাঁ, নীলফামারী ও দিনাজপুরের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে।

দ্য ডেইলি স্টারের রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার আলী জানান, তীব্র তাপপ্রবাহের পাশাপাশি ঘনঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাড়িতে থাকলে বিদ্যুৎ নেই আবার বাইরে গেলে তীব্র গরম। মানুষ এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।

তীব্র গরমের কারণে হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ছে।

নেসকোর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আনোয়ার আলী জানান, রাজশাহী বিভাগে গতকাল রাত ১২টায় ৪৯৮ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৩৭৩ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ১২৫ মেগাওয়াট। একই সময়ে রংপুর বিভাগে ঘাটতি ছিল ৫৪ মেগাওয়াট।

দ্য ডেইলি স্টারের দিনাজপুর সংবাদদাতা কংকন কর্মকার জানান, প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি ঘনঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষ কাজে যেতে পারছেন না।

দিনাজপুর শহরে চলাচলের অন্যতম মাধ্যম ইজিবাইকের সংখ্যা আজ থেকে কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে ইজিবাইকে চার্জ না দিতে পারার কথা বলেন তিনি।

পল্লীবিদ্যুৎ ও পিডিবির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে কংকন কর্মকার জানান, জেলায় ২৪০ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১৪৬ মেগাওয়াট। ঘাটতি রয়েছে ৯৪ মেগাওয়াট। এই ঘাটতি লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সমন্বয় করা হচ্ছে। দিনাজপুরে প্রায় ৪০ শতাংশ লোডশেডিং হচ্ছে।'

নীলফামারীর সিভিল সার্জন ডা. মো. হাসিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাপপ্রবাহের কারণে জেলার হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া রোগীসহ অন্যান্য রোগীর চাপ সংখ্যা বেড়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে হাসপাতালে রোগীদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া শ্বাসকষ্টের রোগীদের নেবুলাইজে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।'

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বলেছেন, 'পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ আছে এবং আমাদের দ্বিতীয় ইউনিটও আগামী ৫ জুনের পর বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, এখানে কয়লার অভাব দেখা গেছে এবং এটা আসতে ২০ থেকে ২৫ দিন লেগে যাবে আমাদের।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এখানে এলসি খুলতে দেরি হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলোও ছিল। এখানে একটা বড় বিদ্যুৎ আমরা পাচ্ছি না সিস্টেমে। এ কারণে আমি মনে করি যে কিছুটা জনদুর্ভোগ হচ্ছে। লোডশেডিং বেড়ে গেছে কয়েকটা বিদ্যুৎকেন্দ্র কাজ না করাতে। তেল আনার জন্য রীতিমত হিমসিম খাচ্ছি। এখন বেশিরভাগ গ্যাস আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে ডাইভার্ট করছি।'

Comments

The Daily Star  | English
BNP demands national election by December 2025

2014, 2018, 2024 polls: BNP to sue former ECs, officials today

BNP is set to file a case against officials involved in the last three national elections with Sher-e-Bangla Nagar police today. The party will also lodge a formal complaint with the Election Commission in this regard, BNP leaders said yesterday.  

4h ago