আদা-পেঁয়াজের ঝাঁঝ কমেনি, মসলার দামও চড়া

‘দাম বাড়ায় মানুষ কিনছে কম।’
ছবি: স্টার

আমদানি বাড়লেও এখনো চড়া আদার বাজার। পেঁয়াজের দামও তুলনামূলক বেশি। সুখবর নেই জিরাসহ অন্যান্য মসলার বাজারেও।

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি বার্মিজ আদা বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৬০ টাকায়, ইন্দোনেশিয়ার আদা বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, ভিয়েতনামের আদা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ও দেশি আদা ৪০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে আদার চাহিদা প্রায় ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে দেশে আদার উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। আমদানি করা হয়েছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৫ মেট্রিক টন। এ বছর উৎপাদন কমে হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে ১৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আদা চাষ হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে হয়েছে ১৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে গড়ে প্রতি কেজি আদার দাম ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। কয়েক মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। অথচ সরকারি হিসেবে জানুয়ারি মাসের পর থেকে প্রায় প্রতি মাসেই আদার আমদানি বেড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৭৪০ মেট্রিক টন আদা আমদানি করা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি করা হয়েছে ১ হাজার ৭৬০ মেট্রিক টন, মার্চ মাসে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫৩০ মেট্রিক টন, এপ্রিল মাসে আমদানি করা হয়েছিল ২ হাজার ৪৫ মেট্রিক টন। মে মাসে তা আবার বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন।

আদার আমদানি বৃদ্ধির পরেও দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের আদা ব্যবসায়ী মো. জসিম বলেন, 'আদা আমদানি করা হলেও তা যথেষ্ট নয়। দেশে এ বছর আদার উৎপাদন কম হয়েছে। আমদানিও চাহিদার তুলনায় কম হয়েছে। এ জন্য দাম অনেক বেশি। কোরবানি ঈদের আগে আদার দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তবে অনেক বেশি আমদানি হলে দাম কিছুটা কমবে। মূলত আমদানি করা ৫০ শতাংশ আদাই থাকতো চীনের। বাজারে চীনা আদা না থাকায় সংকট আরও বেড়েছে।'

আজ কারওয়ান বাজারে ৩ ধরনের পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে। প্রতি কেজি পাবনার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকা, ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকা এবং ভারতের আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়।

৮১ দিন বন্ধ থাকার পর গত ৫ জুন থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। সরকারের এই ঘোষণার পর পরই পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা কমে যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গতকাল বুধবার পর্যন্ত দেশে অনুমোদন দেওয়া ৫ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টনের মধ্যে আমদানি হয়েছে ৫১ হাজার মেট্রিক টন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, এ বছর দেশীয় উৎপাদন ছিল প্রায় ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু, মজুত সুবিধার অভাবে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে, দেশে এখনো প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে।

দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরের পেয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ৩৬ লাখ ৪০০ মেট্রিক টন, চাহিদা ছিল ৩০ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন এবং আমদানি করা হয়েছিল ৬ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন।

পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো আশরাফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার যে উৎপাদন দেখায় তা আসলে সঠিক নয়। এ বছর পেঁয়াজের উৎপাদন অনেক কম হয়েছে। চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশি। আর ভারত থেকে আমদানি শুরু করায় দেশি পেঁয়াজ এখনো ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। না হলে পেঁয়াজের দাম অনেক বেশি হতো।'

আরেক পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বাক্কার শেখ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দাম কিছুটা কমায় কৃষকও পেঁয়াজ বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া বাজারে দেশি পেঁয়াজের চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেশি। কুরবানি ঈদের আগে পেঁয়াজের দাম কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।'

মসলা জাতীয় পণ্যের মধ্যে বাজারে তুলনামূলক কম দামের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে রসুন। আজ প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা এবং চায়না রসুন ১৬০ টাকা।

সরকারি তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৬ লাখ মেট্রিক টনের মতো রসুন উৎপাদন হয়েছে। দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে রসুন উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন, চাহিদা ছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৪ মেট্রিক টন এবং আমদানি করা হয়েছিল ৫০ হাজার ৩৭০ মেট্রিক টন।

অস্থিরতা দেখা গেছে জিরার বাজারে। বাজারে আগে তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান ও ভারতের জিরা পাওয়া যেত। তবে এখন শুধু ভারতের জিরা পাওয়া যাচ্ছে। খুব অল্প পরিমাণে আফগানিস্তানের জিরা পাওয়া যাচ্ছে। আজ প্রতি কেজি ভারতের জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮৩০ থেকে ৮৫০ টাকায় এবং আফগানিস্তানের জিরার দাম ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা।

আজ প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা, লবঙ্গ দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা টাকা, গোলমরিচ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়, দারুচিনি ৪০০ টাকা এবং প্রতি কেজি ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়।

কারওয়ান বাজারে মসলা কিনতে আসা লিপি আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবকিছুর দাম বাড়তি। কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা কিনবো বুঝতে পারছি না। সবকিছুই কম কম করে কিনছি। খাচ্ছিও কম। টাকার কোনো মূল্যই নেই। এখন তো ১ হাজার টাকাতেও বাজার হয় না।'

আরেক ক্রেতা রসিদুল ইসলাম বলেন, 'দিন যতই যাচ্ছে দাম ততই বাড়ছে। সবজির দাম কিছুটা কমের মধ্যে থাকলেও পেঁয়াজ, আদাসহ অন্যান্য জিনিসের দাম অনেক বেশি। আয় বাড়েনি তবে খরচ বেড়েছে ৩-৪ গুণ। টিকে থাকাটাই মুশকিল।'

মসলা ব্যবসায়ী মেসার্স উপহার স্টোরের সত্ত্বাধিকারী মো. চুন্নু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জিরার দাম ২ মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৪০০ টাকার বেশি বেড়েছে, লবঙ্গের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা, গোলমরিচের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ টাকার বেশি।'

এই ব্যবসায়ী বলেন, 'দাম বাড়ায় মানুষ কিনছে কম। মানুষ এখন তেমন অনুষ্ঠান করছে না। ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো না। আগে প্রতিদিন লাখ টাকার মতো বিক্রি হতো। এখন বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মতো।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যে হিসাবগুলো পাই সেগুলো অনেকটাই অনুমান নির্ভর। সরকারের কৃষিবিভাগ, খাদ্য বিভাগ, বাণিজ্য বিভাগের কিছু হিসাব থাকে। তবে সেগুলো অনেক সময়ই হালনাগাদ করা হয় না। নিয়মিত জরিপ হয় না। পুরনো জরিপের ভিত্তিতে অনেক পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদার হিসাব করা হয়। মানুষের আয় কমা-বাড়ার সঙ্গে যে চাহিদার পরিবর্তন হয় অনেক সময় তা আমলে নেওয়া হয় না।'

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'আমাদের দেশের জরিপগুলোতে বৈজ্ঞানিক কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। জেলা উপজেলা থেকে যে অনুমান নির্ভর তথ্য আসে তা গড় করে পণ্যের বার্ষিক উৎপাদন ও চাহিদার হিসাব নির্ধারণ করা হয়। ফলে প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে না। এসব জরিপে যদি জিপিএস ও জিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো এবং কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহের কোনো পদ্ধতি থাকতো তা হলে সঠিক চিত্র পাওয়া যেত।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গরম মসলা প্রায় সবই বাইরে থেকে আমদানি করা হয়। এ জন্য দাম তুলনামূলক বেশি থাকে। তবে আমরা সব মসলা দেশীয়ভাবে উৎপাদনের চেষ্টা করছি। আমরা জিরা চাষ শুরু করেছি, কিছুটা সফলও হয়েছি। আগামীতে ২০ একর জমিতে জিরা চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা ধীরে ধীরে বাড়বে।'

এই কৃষিবিদ বলেন, 'বান্দরবানে একজন চাষি এলাচ চাষ করেছেন। সেটা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া পাহাড়ে গোল মরিচ, দারুচিনির চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা যদি এসব মসলার চাষ বাড়াতে পারি তাহলে আশা করছি আগামী ৫ বছরের মধ্যে মসলার ক্ষেত্রে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবো।'

রাসেল আহমেদ বলেন, 'আমাদের দেশে কী পরিমাণ ফসল উৎপাদন হয় এই হিসাবটি আমরা মাঠ পর্যায়ে যেসব কর্মকর্তা কাজ করেন তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। যে উৎপাদন হয় সেখান থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ বাদ দিয়ে আমরা হিসাব করি এবং তারপরেও কী পরিমাণ আমদানি করতে হয় সে হিসাব যোগ করে চাহিদার হিসাব করা হয়। এখানে আমাদের ১০ শতাংশ এদিক-ওদিক হতে পারে, এর বেশি না।'

আদা-পেঁয়াজ দাম না কমার বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, 'আদার বিষয় আপাতত বলা যাচ্ছে না। তবে ব্যাপক আকারে আমদানি শুরু হলে দাম কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অন্যদিকে ৫ লাখ ৭০ হাজার টনের মধ্যে মাত্র ৫১ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এটি যখন বেড়ে যাবে তখন দাম কমবে বলে আশা করছি।'

Comments