আদার এত গুণ জানতেন কি

আদার পুষ্টিগুণ
ছবি: সংগৃহীত

খাদ্যে ব্যবহৃত একটি পরিচিত উপাদান আদা। এটি মূলত রান্নায় স্বাদ বাড়াতে মশলা হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাশাপাশি এর মধ্যে অনেক ভেষজ গুণও আছে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান।

চলুন আজকে জেনে নিই আদার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আঞ্জুমান আরা শিমুল।

আন্জুমান আরা শিমুল বলেন, আদা এমন একটি উপাদান, যেটি বিভিন্ন রান্নাতে মশলা হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি নিয়মিত কাঁচা খেলেও মিলবে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা।

আদার পুষ্টি উপাদান

আদায় রয়েছে পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন এ, বি৬, ই ও সি এবং অ্যান্টি–ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদানসহ ইত্যাদি বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যা শরীরের অনেক উপকার করে।

প্রতি ১০০ গ্রাম আদা থেকে পাওয়া যায়

ক্যালরি - ৭৯ কিলোক্যালরি

লিপিড - ০.৮ গ্রাম

সম্পৃক্ত চর্বি - ০.২ গ্রাম

কোলেস্টেরল - ০ মিলিগ্রাম

সোডিয়াম - ১৩ মিলিগ্রাম

পটাশিয়াম- ৪১৫ মিলিগ্রাম

শর্করা - ১৮ গ্রাম

খাদ্য আঁশ - ২ গ্রাম

চিনি- ১.৭ গ্রাম

প্রোটিন - ১.৮ গ্রাম

ভিটামিন সি- ৫ মিলিগ্রাম

ক্যালসিয়াম - ১৬ মিলিগ্রাম

আয়রন- ০.৬ মিলিগ্রাম

ভিটামিন বি৬ - ০.২ মিলিগ্রাম

ম্যাগনেসিয়াম ৪৩ মিলিগ্রাম

আদার বিভিন্ন উপকারিতা

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

আদায় রয়েছে ভিটামিন বি৬ এবং সি যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। প্রতিদিন আদা খেলে এটি ইমিউন সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। এটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে এবং অন্যান্য অসুস্থতা যেমন সাধারণ সর্দি বা ফ্লু সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। আদা শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়াকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

হজম ক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়

আদায় থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে। আদার মধ্যে জিঞ্জেরল এবং শোগাওলের মতো যৌগ রয়েছে যা হজমকারী এনজাইমগুলির উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। ফলে খাবার সহজেই পরিপাক হয় এবং দ্রুত হজম হয়। আদা পেটের খাবার হজম ত্বরান্বিত করে, যা বদহজম প্রতিরোধ করতে এবং খাবারের পরে পেট ফোলার অনুভূতি দূর করতে সাহায্য করে। হজমক্রিয়ার উন্নতির ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো রোগ প্রতিরোধ হয়।

আদা গ্যাস কমায়

বেশ কয়েকটি গবেষণায় হজমের সময় অন্ত্রের ট্র্যাক্টে তৈরি হওয়া গ্যাসগুলির উপর আদার প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

আদা পাচক এনজাইম যেমন অ্যামাইলেজ, লাইপেজ এবং প্রোটিয়েজের উৎপাদন উদ্দীপিত করে। এই এনজাইমগুলি যথাক্রমে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট এবং প্রোটিনের ভাঙন প্রক্রিয়াকে বাড়ায়। ফলে খাদ্য আরও সম্পূর্ণভাবে হজম হয়, যা অপরিপক্ক খাদ্য থেকে গ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনা কমায়। এনজাইমগুলি গ্যাসকে ভাঙতে এবং বের করে দিতে সাহায্য করে যে কোনো অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেয়।

অন্ত্রের পেশী শিথিল করে

আদার পেশী শিথিলকারী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্ত্রের পেশীগুলোকে প্রশমিত ও শিথিল করতে সাহায্য করে, খিঁচুনি কমায় এবং হজমের অস্বস্তি কমায়।

বমিভাব কমায়

মোশন সিকনেস, গর্ভাবস্থায় মর্নিং সিকনেস, কেমোথেরাপি বা পোস্ট-অপারেটিভ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময় বমি বমি ভাব হয়। আদা খেলে এ বমি ভাব দূর হয়।

অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রভাব

আদার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি যৌগ যা পাচনতন্ত্রের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। অ্যাসিড রিফ্লাক্স, গ্যাস্ট্রাইটিস এবং ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের (আইবিএস) মতো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অবস্থার কারণে সৃষ্ট প্রদাহ থেকে মুক্তি দেয়।

অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটার ভারসাম্য বজায় রাখে

আদার প্রিবায়োটিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। সামগ্রিক হজম স্বাস্থ্য এবং কার্যকারিতার উন্নতি ঘটায়।

স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে

আদা স্নায়ুতন্ত্রের ওপর একটি শান্ত প্রভাব ফেলে, যা স্ট্রেস-সম্পর্কিত হজম সংক্রান্ত সমস্যাগুলো কমাতে এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অস্বস্তির সময়ে শিথিলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

প্রদাহ হ্রাস

অস্টিওপোরেসিস ও আর্থ্রাইটিস রোগে সৃষ্ট প্রদাহের চিকিৎসায় আদা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। আদার ফাইটোকেমিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলি প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। আদার জিঞ্জেরল যৌগগুলি ব্যথা নিরাময়ে অংশগ্রহণ করে। বিশেষভাবে ডিসমেনোরিয়া অর্থাৎ পিরিয়ড শুরু হওয়ার ঠিক আগে বা পরে ব্যথা নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ করে

আদার নির্যাস কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।

২০১৭ সালে চার হাজার ৬২৮ জনের উপর গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন আদা খেলে অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার মধ্যে করোনারি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাইপারলিপিডেমিয়া, সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ এবং ফ্যাটি লিভারের রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। আদা একটি প্রতিরোধমূলক থেরাপি হিসাবে কাজ করতে পারে।

ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় আদা

আদা প্রোটিন বা অন্যান্য পুষ্টি সরবরাহ করে না। তবে এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি চমৎকার উৎস। আদা বিভিন্ন ধরনের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে পারে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ঘটতে পারে যখন অনেক ফ্রি র‍্যাডিক্যাল শরীরে তৈরি হয়। ফ্রি র‍্যাডিক্যাল হল বিপাক এবং অন্যান্য কারণে শরীরে উৎপাদিত বিষাক্ত পদার্থ। ফ্রি র‍্যাডিক্যাল শরীরের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যা রিউমাটয়েড আর্থাইটিস, হার্ট অ্যাটাক, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ এবং ক্যানসারের কারণ হতে পারে।

খাদ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি শরীরকে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতে পারে। আদা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের কিছু ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে কোলোরেক্টাল ক্যানসার, গ্যাস্ট্রিক ক্যানসার, প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার এবং লিভার ক্যানসার।

ওজন কমায়

আদায় এমন কিছু উপাদান আছে যা বিপাক ক্রিয়া বৃদ্ধি করে, ক্ষুধা কমায় এবং শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে।

ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে

আদার প্রাকৃতিক তেল, যাকে জিঞ্জেরল বলা হয়, এটি খসখসে ত্বককে প্রশমিত করতে এবং একজিমা এবং সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের অবস্থার প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

আদায় থাকা জিঞ্জেরলের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য ব্রন কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং কাঁচা আদা ব্রনের দাগ দূর করতে সাহায্য করে।

আদা ত্বকের অতিরিক্ত তেল উৎপাদন কমাতে পারে। এতে ত্বক উজ্জ্বল হয়। এটি ত্বককে পুনরুজ্জীবিত করে।

সতর্কতা

আদা খাওয়া উপকারী হলেও কিছু ক্ষেত্রে আদা ক্ষতিকর হতে পারে।

গর্ভাবস্থায়

 যদিও বলা হয়ে থাকে গর্ভাবস্থায় আদা খুবই প্রয়োজনীয়, তবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত তা গ্রহণ করা উপকারী। এর চাইতে বেশি নয়। পরিমাণটি হলো ১ গ্রাম অথবা ১০০০ মিলিগ্রাম। প্রেগন্যান্সিতে বেশি আদা খেলে পেশীর সংকোচন ঘটিয়ে প্রিটার্ম গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে। তাই অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আদা খান।

হিমোফিলিয়া বা জিনগত রোগের ক্ষেত্রে আদা অপকারী

হিমোফিলিয়ার সমস্যা থাকলে আদার এই গুণ নেগেটিভ প্রভাব ফেলতে পারে। হিমোফিলিয়া বংশগত ডিজঅর্ডার। হিমোফিলিয়ার ওষুধের সঙ্গে আদা খেলে তা ওষুধের প্রভাবে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

কিছু কিছু ওষুধের সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় আদা

হাইপারটেনসন বা ডায়াবেটিসের ওষুধ খেলে আদা খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভাল। আদা রক্তকে পাতলা করে রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। তাই সাধারণভাবে আদা খাওয়া উপকারী হলেও অ্যান্টি-কোয়াগুলান্ট, বিটা-ব্লকারস বা ইনসুলিনের মতো ওষুধের প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে আদা।

অতিরিক্ত আদা খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিতে পারে হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা। এছাড়া ঝাপসা দষ্টিশক্তি, অনিদ্রাও হতে পারে আদা অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে। এভাবে রক্তচাপের ওঠানামার ফলে হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তাই হৃদযন্ত্র ঠিক রাখতে আদা খাওয়ার বিষয়ে সতর্ক হোন।

 

Comments