রোগ মুক্তির আশায় হাসপাতালে এসে আরও বেশি রোগাক্রান্ত

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
বেড না পাওয়ায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে শীতজনিত রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চিকিৎসা সেবার সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান ৫০০ শয্যার খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতাল। বছরজুড়ে এই হাসপাতালে শয্যাসংকট থাকে।

হাসপাতালের প্রায় সবগুলো ওয়ার্ড ও ইউনিটের সামনের বারান্দা, করিডোর, লিফটের সামনের ফাঁকা জায়গা, সিঁড়ির আশেপাশের জায়গা রোগী ও তাদের স্বজনরা পলিথিনের বেডশিট বিছিয়ে চিকিৎসা নেন।

শীতে চিকিৎসা প্রার্থীদের পড়তে হয় চরম সংকটে। গত কয়েকদিনের প্রচণ্ড শীতে কয়েক শ রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

খুলনা বিভাগের ১০ জেলাসহ আশেপাশের জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন ২ হাজারের মতো রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন এই হাসপাতালে। শীত ছাড়া অন্য সময় নিয়মিত ১ হাজার ৫০০-র বেশি রোগী এখানে ভর্তি থাকেন।

এই সময় সর্দি, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত সহস্রাধিক রোগী প্রতিদিন সেবা নিচ্ছেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রোগীদের অধিকাংশই শয্যা সংকটে থাকেন। বিপাকে পড়েছেন শিশুদের নিয়ে আসা অভিভাবকেরা।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় কাঁথা ও পলিথিনের বেডশিট দিয়ে তীব্র শীত থেকে রক্ষার চেষ্টা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৫০০। গতকাল রোববার সেখানে ভর্তি ছিল ১ হাজার ৮৩ জন।

গত শনিবার সকাল ৭টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত নতুন ভর্তি ছিল ২২৭ জন। ৩০ শিশু আছে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে।

হাসপাতালের তথ্যানুসারে, গত বুধবার ১ হাজার ১৯২ রোগী ভর্তি ছিল। এর আগের দিন ছিল ১ হাজার ২২০ জন।

বুধবার সকাল ৭টার পর থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত নতুন রোগী ভর্তি ছিল ২৭১ জন। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৪১ জন শিশু। এ সময়ের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের, এর ৬ জনই শিশু।

খুমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ডায়রিয়া, সর্দি, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এসব রোগে আক্রান্তরা এখানে বেশি ভর্তি হচ্ছেন। তারা এই তীব্র শীতে এখানে এসে আরও বেশি বিপদে পড়েছেন।'

'যেখানে রোগীকে শীতের হাত থেকে বাঁচানো বেশি দরকার সেখানে তারা খোলা জায়গায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকেই এসব কারণে রোগ মুক্তির পরিবর্তে আরও বেশি রোগাক্রান্ত হচ্ছেন,' যোগ করেন তিনি।

যদিও অন্য সময়েও হাসপাতালের শয্যা ফাঁকা থাকে না বলে তিনি জানান।

নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী আরও বলেন, 'বয়স্ক রোগীদের বেশির ভাগই শ্বাসকষ্টের কারণে ভর্তি হয়েছেন। অধিকাংশ শিশুরও একই সমস্যা। এ ছাড়াও ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুরাও এখানে আছে।'

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে রোগী ও তাদের স্বজনরা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের কয়েকটি ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক শ রোগী বারান্দায়, করিডোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের পাশে স্বজনেরাও বিছানা পেতেছেন। কেউ কেউ শীতের হাত থেকে বাঁচতে গ্রিলের রডের সঙ্গে তাঁবুর মতো করে বেডশিট বা পুরু কাঁথা দিয়ে বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ পলিথিন টাঙিয়েছেন ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচার জন্য।

কোনো কোনো ওয়ার্ডের সামনে পা ফেলারও জায়গা নেই। হাসপাতালের চতুর্থ তলায় শিশু ওয়ার্ডের করিডোরে অতিরিক্ত বেড ফেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সেখানেও স্থান-সংকুলান না হওয়ায় অসুস্থ শিশুদের নিয়ে স্বজনেরা মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারি গ্রাম থেকে ১০ দিন আগে খাদিজা বেগম তার ৬ বছরের ছেলেকে নিয়ে আছেন শিশু ওয়ার্ডে। তীব্র জ্বরে কাতর সিয়াম যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।

খাদিজা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এত জোরে জোরে ওর সঙ্গে কথা বলছি কিন্তু সে কিছুই শুনতে পারছে না।'

তিনি আরও বলেন, 'ঠান্ডা থেকেই এই সমস্যা হয়েছে বলে ডাক্তার জানিয়েছেন।'

শিশু ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার চিকিৎসক মো. আবু জাহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সম্প্রতি, তীব্র শীতের কারণে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। এরই মধ্যে আমাদেরকে চিকিৎসা দিয়ে যেতে হচ্ছে।'

যশোরের চৌগাছা থেকে এসেছেন আব্দুল জব্বার। গত ৫ দিন আগে ছেলের সঙ্গে এসে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রথম দিন থেকেই শয্যার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই বেডের ব্যবস্থা করতে পারেননি। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় মেডিসিন বিভাগের করিডোরে তারা পলিথিন আর বেডশিট দিয়ে বিছানা পেতেছেন।

ছেলে মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আব্বা বার্ধক্যজনিত কারণে নানাবিধ সমস্যায় পড়েছেন। শ্বাসকষ্টেও ভুগছেন। ডাক্তার অনেকগুলো পরীক্ষা দিয়েছেন। সেভাবেই চিকিৎসা চলছে।'

'ফাঁকা জায়গা ঠান্ডায় তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন,' যোগ করেন তিনি।

হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার শেখ রবিউল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫০০ শয্যা হলেও আগের সেই ২৫০ শয্যার জনবল এখনো আছে। প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ রোগী ভর্তি থাকছেন। কখনো এই সংখ্যা ১ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০-র বেশি রোগী আসছেন। এই সংখ্যা কখনো ২ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

১৯৮৯ সালে খুলনা নগরীর বয়রাতে ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে একে খুলনা মেডিকেল কলেজে রূপ দেয় সরকার। ২০০৮ সালে একে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।

 

Comments

The Daily Star  | English

Lives on hold: Workers await reopening of closed jute mills

Five years on: Jute mill revival uneven, workers face deepening poverty

15h ago